২০১২
সাল নাগাদ আমার একজন ছাত্র ‘দ্য আর্টিস্ট’ নামে একটি সিনেমার সন্ধান দিল। সন্ধান মানে আমার কম্পিউটারে তার পেন ড্রাইভ থেকে একেবারে লোড
করে দিয়ে গেল। দেখবো দেখবো করে আর দেখা হয়ে উঠছিল না। কেন জানি না ‘দ্য আর্টিস্ট’ নামটা আমাকে টানেনি। মায়ের
কাছে মাসীর গপ্পো শুনবো? হয়তো আমার অশিক্ষার কারণেই ‘আর্টিস্ট’-এর ব্যাপকতা বুঝতে ভুল করেছিলাম! অনেকটা যেন সে কারণেই
ভেতর থেকে উৎসাহ পাচ্ছিলাম না দেখার। দেখা
হলেই ছাত্রটি জানতে চাইতো, দেখেছি কিনা। একদিন দুপুরে চালিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝলাম সর্বনাশ, এ তো আর উঠতে
দেবার না। কাজ রয়েছে, কিছুক্ষণ বাদে
বেরনোর দরকার ছিল, তার কী হবে? কে যেন পা দুটো পাথর করে দিয়েছে। নড়াচড়ার শক্তি
যেন হারিয়ে ফেলেছি। বুঝতে পারলাম কাজ টাজ ভোগে গেল। পুরোটা না দেখে জগৎ রসাতলে
গেলেও আমি উঠতে পারবো না। বিস্ফারিত চোখে দেখেই গেলাম। ছাত্রটির ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে
গেল। হোক না সে আমার ছাত্র, এমন ছবি দেখা্নোর জন্য যে বার বার তাড়া দেয় তার ওপর
শ্রদ্ধা বাড়বে না?
আমার মতে ‘দ্য আর্টিস্ট’ (২০১১) ছবির
মূল আকর্ষণ উপস্থাপনায়। যার একশো শতাংশ কৃতিত্ত্ব ফরাসি পরিচালক মাইকেল হাজানাভিসিয়াস-এর।
কিন্তু এ ছবির অভিনয়ও তুলনাহীন। কাহিনি খুবই সাদামাটা। ফরাসি পরিচালকের ফরাসি ছবি হলেও কাহিনি হলিউডের এক বিখ্যাত
ফিল্মস্টারের জীবন নিয়ে। হলিউডি ছবি সাধারণত ছকে বাঁধা দুইয়ে দুইয়ে চারের
মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। যদিও
কিছু কিছু ছক কাঙ্ক্ষিত, হৃদয়ে সারাজীবন থেকে যায়। চলচ্চিত্র ইতিহাসে এমন হলিউডি
ছবির সংখ্যা কম নয়। ‘দ্য আর্টিস্ট’ তেমনই ছকে থেকেও ছকের বাইরের। হৃদয় জুড়ে রয়ে গ্যাছে।
ঘটনা ১৯২৭ সালের। নির্বাক যুগের হলিউডের এক
বিখ্যাত স্টার অভিনেতা জর্জ ভেলেন্টিন। তিবি এমনই
স্টার যে জীবদ্দশাতেই তাঁর লাইফ সাইজ পোট্রেইট আঁকা হয়েছে। বিশাল
প্রতিপত্তি নিয়ে দাপটে হলিউড রাজ করছেন। নায়কের একটু ছোঁয়া পেতে মেয়েরা পাগল।
উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে আসে। কোথায় যেন পড়েছিলাম একদা বলিউডি সুপারস্টার নায়ক রাজেশ
খান্নার কলকাতায় একটি ছবির শ্যুটিং-এর সময় তাঁর সাদা গাড়ি নাকি
মেয়েদের লাল লিপস্টিকের ছাপে ভরে গিয়েছিল। সে যুগের বঙ্গললনাদের এ্যাতোখানি বেপরোয়া
উদারতার কাহিনি বেশ রোমাঞ্চকর। এমনও নাকি ঘটেছে, নায়ক রাজেশ খান্নার জ্বর হলে লেডিস
হস্টেলের মেয়েরা উপোস করতো। তিনিই বলিউডের একমাত্র নায়ক যাঁর পর পর ১৫টি ছবি
সুপারহিট হয়েছিল। সেই রাজেশ খান্নার
শেষ দিনগুলোর কথা ভাবুন! মুম্বাই-এর মেরিন ড্রাইভ বিচে বিকেলে একা বসে থাকতেন। কেউ কি চিনতে
পারত তাঁকে? মনে পড়ে নায়কের চির
বিদায়ের কয়েকমাস আগের সেই বিখ্যাত এক কোম্পানির ফ্যানের বিজ্ঞাপনের কথা? জীবনের
প্রথম ও শেষ অ্যাড। একটি অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করে পাকা দাড়ির শীর্ণকায় নায়ক দেখছেন
গ্যালারিময় টেবিলফ্যান। উপর থেকে ঝুলছে সিলিংফ্যান। চারদিক থেকে নাটকীয় আলো এসে
পড়েছে। নায়ক বলছেন - “হাওয়া বদল স্যাকতা হ্যায়, লেকিন
ফ্যানস হামেসা মেরি রহেঙ্গে। বাবুমশাই, মেরে ফ্যানস মুঝসে কোই নেই ছিন স্যকতা।”
সময়টা ২০১২।
টিভিতে যখনই এই অ্যাড দেখতাম চোখের জল ধরে রাখতে পারতাম না। আমি
রাজেশ খান্নার ফ্যান নই। হাতে গোনা একটা কি দুটো সিনেমা হয়তো দেখেছি। কিন্তু ওঁর
দেশজোড়া জনপ্রিয়তার আঁচ পেতাম না তো নয়! সেই নায়ককে শেষ জীবনে এমন একটি বিজ্ঞাপনে
প্রকাশ হতে হলো, যেখানে তিনি নিজেই নিজের করুণ বাস্তবতাকে দর্শকের কাছে তুলে
ধরলেন! বা তাঁকে দিয়ে তুলে ধরানো হলো। অন্তিম বয়সে নায়কের বোধশক্তি হারানোকে কাজে
লাগানো? বিজ্ঞাপন জগত কতটা যে হৃদয়হীন নির্মম, এ তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে
ইতিহাসে।
আলোচিত ‘দ্য আর্টিস্ট’ ছবির নায়কেরও যেন একই পরিণতির প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম। প্রায় একই সময় (২০১২) সিনেমাটি দেখা আর রাজেশজীর ওই
এ্যাড একাকার হয়ে একটু বেশি মাত্রায় আমাকে আবেগময় করে তুলেছিল হয়তো!
প্রথম দৃশ্য। একটি সিনেমা হলের পর্দায় ভেসে উঠল ইলেকট্রিক শক্ দেওয়া এক নায়কের মুখ থেকে কিছু
কথা বের করার চেষ্টা হচ্ছে। নায়ক বলছেন ‘আমি কথা বলতে পারছিনা’। শত্রু পক্ষ বলছে
‘আপনাকে কথা বলতেই হবে’। ‘না, আমি পারব না’। সিনেমা হলের পর্দাজুড়ে নায়কের
যন্ত্রনাময় মুখ। পরবর্তী পর্যায়ে নায়কের অবস্থান দেখলে বোঝাযাবে প্রথম দৃশ্যেই কি
সুরে পরিচালক বেঁধে ফেলেছেন! ক্যামেরাকে ঘোরানো হলো সিনেমা হলের ভিতরে। দেখা
যাচ্ছে কানায় কানায় পরিপূর্ণ দর্শকের বিস্ফারিত চোখ পর্দার দিকে। এরপর নায়কের অচৈতণ্য দেহটি টানতে টানতে রাখা
হল কারাগারে। কিছুক্ষনের মধ্যে নায়কের পোষা কুকুর কারাগারের জানালা দিয়ে ঢুকে নায়কের
ঘাড় গলা চাটতে লাগল। সুখানুভূতি মিশ্রিত মুখভঙ্গিতে নায়কের জ্ঞ্যান ফিরল। দর্শকের দিকে ক্যামেরা ঘুরতে দেখা গেল বিশ্ময় বিমুঢ় হয়ে
তারা দেখছে। মাঝে মাঝে বিস্ময়ের মৃদু প্রকাশ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এবার ক্যামেরাকে ধরা
হলো পর্দার পেছন দিক থেকে। যেখানে
নায়কের চরিত্রে অভিনয় করা রিয়েল নায়ক জর্জ ভেলেন্টিন গর্বের সঙ্গে দেখছেন তাঁর অভিনীত ছবিটি। মাঝে মঝে তাঁর খুশির অনুভূতি ভাগ করে নিচ্ছেন ইউনিটের অন্যান্যদের
সঙ্গে। তিনি দেখছেন পর্দার পেছন থেকে,
ফলে পর্দায় পড়া দৃশ্য উল্টো ভাবে দেখানো হচ্ছে। চিরাচরিত হলিউডি কায়দায় আর একটি ঘরে বন্দী থাকা নায়িকাকে উদ্ধার করে দুজনেই চম্পট দিল বন্দিশালা থেকে। পর্দায় দেখানো
হলো সমাপ্ত। দর্শকদের করতালিতে ফেটে পড়ল সিনেমা হল। পর্দার পেছনে নায়ক জর্জ ছবির প্রডিউসার পরিচালক ও অন্যান্যরা খুশিতে আত্মহারা
হয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছেন।
মনে রাখতে হবে ঘটনাটি নির্বাক
যুগের (১৯২৭)। তখন সিনেমা চলাকালীন মিউজিসিয়ানরা দর্শকের সামনে সরাসরি মিউজিক
বাজাতেন। ছবির ডায়লগ বড় বড় রোমান হরফে ভেসে উঠত পর্দায়। তা পড়েই বুঝতে হতো কথপোকথন।
সে যুগের নায়ক নায়িকাদের পোশাক আশাক, হাঁটা চলা, ভঙ্গী নিখুঁতভাবে ‘দ্য আর্টিস্ট’-এ
ধরা হয়েছে। নির্মাণ পর্ব ২০১১ সালে হলেও
দর্শকরা ফিরে যেতে পারে সেই নির্বাক যুগে।
প্রিমিয়ার শো’র শেষে সিনেমা হলের সামনে নায়ককে
ঘিরে ধরছে সাংবাদিকরা। চারদিকে ঝলসে উঠছে ফ্ল্যাশ বাল্বের আলো। খুশিতে ডগমগ নায়ক সাংবাদিকদের সামনে নানান অঙ্গভঙ্গি ও নেচেকুঁদে পোজ দিয়ে চলেছেন। বাঁধনহারা
নায়কের ফ্যানরা তাঁকে ছোঁয়ার জন্য উদগ্রীব। বিশেষ করে যুবতী মেয়েরা। ঘটনাচক্রে একটি মেয়ের মানিব্যাগ ব্যারিকেডের মধ্যে পড়ে গেল। হয়তো ইচ্ছে করেই মেয়েটি ফেলে দিয়েছিল! মানিব্যাগটি যেই না
সে কুড়োতে গিয়েছে পেছন থেকে অন্যান্যদের ঠেলায় একেবারে নায়কের কাছাকাছি চলে গেল সে। জর্জের নজরে পড়ল মেয়েটি। প্রথমে মুচকি হাসি,
পরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল নায়ক। তাঁর ফ্যানরাও। মেয়েটি সুযোগ হাতছাড়া করল না। সপাটে চুম্বন বসিয়ে দিল নায়কের গালে। খচাখচ ক্যামেরা বন্দী হলো সে দৃশ্য।
পরের দিন একটি বিখ্যাত সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় আধপাতা জোড়া ছবি সহ বিরাট হরফে ক্যাপশন, "Who's That Girl?"। সেদিনই
মেয়েটি একটি ফিল্ম স্টুডিওতে অডিসনের জন্য যাচ্ছিল। সঙ্গে করে নিয়ে যেতে ভুলল না সংবাদপত্রটি।
মেয়েটির নাম পেপি মিলার। ভালো নাচতে পারে,
ফলত অডিশনে মনোনীতও হয়ে গেল। ঘটনাচক্রে তার প্রিয় নায়ক জর্জের সঙ্গে সেই স্টুডিওতেই দেখা। জর্জের নিজস্ব মেকাপ রূমে নিভৃতে প্রবেশ করে তাঁর পরনের কোট জড়িয়ে আশ্চর্য
ক্যারিকেচারে নিজের ভালোবাসা নিবেদন করতে দেখা গেল পেপি মিলারকে। হঠাৎ জর্জ তাঁর মেকাপ রুমে ঐ আশ্চর্য মুহূর্ত চাক্ষুষ করে ফ্যালেন। পেপি
লজ্জা পেলেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ পরিকর। সে অভিনেত্রী হতে চায়। জর্জ পেপিকে
বললেন ‘অভিনেত্রী হতে গেলে এমন কিছু দরকার যা অন্যের নেই’। পেপির গালের একদিকে নিজের
মেকাপ পেন্সিল দিয়ে একটা ছোট্ট তিল এঁকে নাম দিলেন ‘বিউটি স্পট’।
এটাই পেপি ও জর্জের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
পরের শুটিং থেকে নায়ক তার মনসংযোগ হারাতে থাকল। শুরু হলো নায়কের নিচে নামা আর পেপির তরতর করে উপরে ওঠা। সাধারণ নাচিয়ে হিসেবে অভিনয় শুরু করলেও অভিনেত্রী রূপে
শিল্পী-তালিকায় পেপির নাম তালিকার উপরে ক্রমশ উঠতে থাকে। এই ওঠার অন্যতম কারণ সে যুগের
সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্বাক থেকে সবাক সিনেমার পথে গা ভাসিয়েছে। নায়ক নির্বাক
সিনেমাতেই তাঁর বিশ্বাস অটুট রেখেছে। যে প্রডিউসার পরিচালক একের পর এক নায়কের ছবি
করেছেন তিনি তখন ঝুঁকেছেন নব্য সবাক প্রবাহে। পরিচালক একদিন জর্জকে তাঁদের
প্রাইভেট অডিটোরিয়ামে একটি নতুন ব্যাপার দেখানোর জন্য আমন্ত্রন জানালেন। মঞ্চে
মাইকের সামনে একটি মেয়ে কিছু বলছেন। বোঝা
গেল সাউন্ড টেস্ট হচ্ছে। জর্জ পরিচালকের দিকে ইঙ্গিত করে বোঝাতে চাইলেন এ সব কি
হচ্ছে? পরে তাচ্ছিল্লের হাসি হেসে বেরিয়েও গেলেন। যাওয়ার সময় পরিচালক জর্জকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আজ হাসছো, কিন্তু এটাই ভবিষ্যৎ’। জর্জ তাচ্ছিল্যের সুরেই
উত্তর দিলেন ‘থাকুন আপনি আপনার ভবিষ্যত নিয়ে’।
এর পর এক
অসাধারণ প্রতীকী স্বপ্নের দৃশ্যায়ন। আমার মতে এই দৃশ্যটি ছবির সেরা। নিজের মেকাপ
রুমে জর্জ পানীয়র গ্লাস টেবিলে রাখতেই তার কানে ভেসে এল গ্লাস রাখার শব্দ। জর্জ
অবাক হলেন। এটা কি করে সম্ভব? টেবিলের অন্যান্য জিনিস নাড়াচাড়ার শব্দও
কানে ভেসে এল। দর্শকরাও এই প্রথম কোনো শদ শুনতে পেল। জর্জ নিজের পেনটা একটু উপর
থেকে টেবিলে ফেললেন। তারও শব্দ শুনতে পেলেন, কিন্তু নিজে যখন গলা দিয়ে স্বর বের
করতে চাইছেন কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। হঠাৎ টেলিফোনে রিং বাজতে শুরু করল। আরও
আশ্চর্য হয়ে পিছোতে গিয়ে চেয়ারে হুমড়ি খেলে পড়তেই নিজের পোষা কুকুরটাও ঘেউ ঘেউ করে
ডেকে উঠল। মেকাপ রুমের বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে চাইছেন, কিন্তু তাঁর
গলা থেকে কোনো স্বর বের হচ্ছে না। ছুটে স্টুডিওর বাইরে বেরিয়ে দেখলেন দূর থেকে
পেপি মিলার ছোট্ট নাচের ড্রেসে খিল খিলিয়ে হেসে চলেছেন। পরে আরো দুজন থেকে অনেকজন
সুন্দরী নাচিয়েরা তার দিকে স্ব-শব্দ ব্যঙ্গাত্মক হেসে
হেসে চলে যাচ্ছেন। সোঁ সোঁ হাওয়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে, কিন্তু জর্জের গলার স্বর শোনা
যাচ্ছে না। আকাশ থেকে একটা পালক মাটির দিকে উড়তে উড়তে নেমে আসছে। পালক মাটি স্পর্শ
করতেই প্রকান্ড শব্দ। জর্জ দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরলেন। যন্ত্রনাময় মুখ।
সেই প্রথম দৃশ্যের শক্ দেওয়া মুখটিই যেন ভেসে এল পর্দায়। হয়তো অদৃশ্য কেউ তাঁকে
বলছেন - আপনি কথা বলুন? কিন্তু জর্জ কথা বলতে পারছেন না। স্বপ্ন ভাঙতে দেখা গেল তিনি
ঘর্মাক্ত। স্ত্রীর পাশে শুয়ে রয়েছেন।
পরের
দিন জর্জ স্টুডিওতে গিয়ে জানতে পারলেন নির্বাক শ্যুটিং বন্ধ, শুধু সবাক ছবিরই সুটিং হবে। মালিকের সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইলেন
ব্যাপারটা কী? মালিক বোঝালেন, নতুন যুগের মানুষ এসব আর নিচ্ছে না। তারা সাইলেন্ট
ছবি পছন্দ করছেনা, তারা চাইছে ‘ফ্রেস মিট’। মালিকের কাছে জর্জ অঙ্গীকার করে এলেন,
তিনিই একমাত্র যিনি এমন নির্বাক ছবিই বানিয়ে যাবেন যেভাবেই হোক। ফিরে আসার সময়
টেবিলের ওপর রাখা বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে পেপি মিলারের ছবি সহ রিভিউ-এর দিকে নজর
যেতে জর্জ মালিককে ব্যঙ্গাত্মক
ইঙ্গিত করলেন ‘এই আপনার ফ্রেস মিট?’
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের শিল্পী গল্পে মদন তাঁতির
কথা মনে পড়ে? সেও শিল্পী। নিজের আদর্শে অবিচল। সেই
কথাটা - ‘মদন তাঁতি যেদিন গামছা বুনবে!’ এ যেন সূর্য পশ্চিমদিকে ওঠার মতো মদন
তাঁতির গামছা বোনার তুলনা। প্রডিউসার
পরিচালক যেন ভুবন মন্ডল। মদনকে বোঝাতে চাইছেন, কিন্তু মদন তাঁর বিশ্বাসে অবিচল। একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, আর একজন লেখক দুজনেই
প্রচলিত শিল্পীর ধারণা থেকে এমন দুটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যাঁরা নিজেকে কোনো
প্রলোভনের কাছে সঁপে দেননি। শত
কষ্টেও নিজের আদর্শ থেকে সামান্য বিচ্যুত হননি। যুগ তো এগিয়ে চলারই। কেউ তাল মেলাতে পারে কেউ পারে না। যে পারে না সে পিছিয়ে যা্য। পৃথিবী
এভাবেই চলতে থাকে। কালের ছাঁকনিতে কে যে শেষ
পর্যন্ত ছাঁকা হয়ে টিকে থাকবে তা কেউ বলতে পারে? তবুও আমাদের কত অহঙ্কার, আস্ফালন!
আবার কাহিনিতে
ফেরা যাক। জর্জ নিজে্র প্রোডাকশনে ও পরিচালনায় নির্বাক ছবি বানাতে শুরু করলেন। কিন্তু নব্য যুগে ওঁর ছবি পাত্তাই পেলনা। মাত্র কয়েক বছর
আগে সিনেমা হল ভর্তি প্রিমিয়ার শো’র পর
যে নায়ককে ফ্ল্যাশ বাল্বের ঝলকানিতে
ইন্টারভিউ দিতে দেখা গিয়েছিল, তাঁরই বানানো ছবির প্রিমিয়ার শো দর্শক শূন্য। হাতে
গোনা কয়েকজন দর্শকের মধ্যে পেপি মিলার তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে এসেছিলেন ছবি দেখতে।
জর্জ সিনেমা হলের একপাশে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ মনে দেখছিলেন তাঁর তলিয়ে যাওয়া পরিণতি।
ছবির দৃশ্যও ছিল তাই - নায়ক চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছেন। নায়িকা হাতধরে টানার চেষ্টা
করেও পারলেন না নায়ককে বাঁচাতে।
ক্যামেরা ধরল দর্শক হিসেবে বসে থাকা পেপি মিলারকে। তার চোখে জল। যদিও জর্জ জানতেও
পারেননি দর্শক হিসেবে তাঁর শো’তে পেপি এসেছিলেন!
ভারাক্রান্ত মনে হাঁটতে হাঁটতে পাশের সিনেমা
হলের হোর্ডিং-এর দিকে জর্জের চোখ পড়ল, দেখলেন সেখানে চলছে পেপি মিলারের ছবি ‘বিউটি
স্পট’। যা তাঁরই দেওয়া নাম। একই দিনে
পেপির ছবি মুক্তি পেয়েছিল। দর্শকের ঢল নেমেছে সে সিনেমা হলের সামনে।
করুণ থেকে করুণতর অবস্থায় জর্জ ক্রমশ
তলিয়ে যেতে থাকলেন। তাঁর স্ত্রী জর্জকে
যুগের সঙ্গে তালমিলিয়ে সবাক ছবিতে আসার অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়ে একসময় জর্জকে
ত্যাগকরে চলে যেতে বাধ্য হলেন। পেপিও
জর্জের বাড়িতে এসে বোঝাতে চাইলেন একসঙ্গে সবাক ছবি করার, কিন্তু জর্জ অবিচল তাঁর
সিদ্ধান্তে। নিজের টাকায় একের পর এক নির্বাক ছবি করে ফ্লপ হতে হতে তিনি প্রায়
নিঃশেষ। চলচ্চিত্র জগতে কেউ আর তাঁকে পাত্তা দেয় না। তাঁর বানানো সিনেমার পোস্টারে
মানুষ পা মাড়িয়ে চলে যায়। ১৯২৯ সালে আমেরিকার ভয়াবহ স্টকমার্কেটের পতন জর্জকে
চরমতম দারিদ্রের মধ্যে টেনে নামাল। সামান্য পানীয় জোগাড় করতে অতি অল্প মুল্যে
নিজের কোট বিক্রি করলেন। চিরদিনের অ্যাসিস্টেন্ট
কাম ড্রাইভারকে একবছর কোনো বেতন দিতে পারেননি। তাকে বিদায় জানতে বাধ্য হলেন। জর্জ
তাঁর সমস্ত মহামুল্য সামগ্রী নিলামে চড়িয়ে কিছু অর্থ পেলেন।
প্রচণ্ড হতাশা জর্জকে গ্রাস করল। নিলামের টাকায় চলল দিনের পর দিন শুধু মদ্যপান। একদিন নিজের প্রজেক্টরে বিগত
দিনের জনপ্রিয় সিনেমাগুলো দেখতে দেখতে নেশার ঘোরে আলমারি ভর্তি সমস্ত ফিল্ম উন্মাদের মতো মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে আগুন ধরিয়ে দিলেন। ধোঁয়ায় দমবন্ধ প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে নাটকীয় ভাবে বেঁচে ফিরলেন তাঁর প্রিয়
পোষা কুকুরটির জন্য। অচৈতন্য অবস্থাতেও পেপির সঙ্গে প্রথম করা একটি দৃশ্যের
র-ফিল্মের একমাত্র অক্ষত রোলটি বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন।
পেপি অনেক উপরে উঠলেও জর্জের প্রতি তাঁর
কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা অটুট ছিল। হাসপাতাল থেকে পেপি নিজের বাড়িতে জর্জকে নিয়ে গেলেন
সেবাশুশ্রুষা করে সুস্থ করার জন্য। পরে জর্জ জানতে পারলেন ঘটনাটা। পেপি প্রডিউসার
পরিচালককে যেন তেন প্রকারে রাজি করাতে চাইলেন, যদি সিনেমা করতে হয় তবে সে জর্জের
সাথে একসঙ্গেই করবেন। না হলে করবেন না। নিতান্ত
অনিচ্ছাসহ পরিচালক রাজি হলেন।
একদিন পেপির অবর্তমানে তাঁর বাড়ির এদিক
সেদিক ঘুরে দেখতে দেখতে একটি বন্ধ ঘরে জর্জ আবিষ্কার করলেন নিলামে বিক্রি হওয়া
প্রতিটি সামগ্রী, এমনকি জর্জের বিশাল পূর্ণায়বব তৈলচিত্রটিও সে ঘরে সাদা কাপড়ে
ঢাকা রয়েছে। জর্জের বুঝতে বাকি রইল না যে তাঁর সমস্ত নিলামে বিক্রি হওয়া জিনিস
কিনে নিয়ে এসেছেন পেপিই। ভীষন আত্মসম্মানে লাগল
জর্জের। মুহূর্তে সেখান থেকে বাড়িতে ফিরে বাক্সে রাখা নিজস্ব পিস্তলের নল মুখে
ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়ে আবারও নাটকীয় ভাবে বেঁচে গেলেন। আসলে প্রডিউসার
পরিচালককে রাজি করিয়ে পেপি নিজেই এসেছিলেন আনন্দ সংবাদটা জর্জকে দিতে। বাড়িতে এসে
শুনলেন জর্জের সবকিছু জেনেফেলা ও চলে যাওয়া। কালবিলম্ব না করে পেপি নিজেই অপটু
হাতে গাড়ি চালিয়ে ছুটে এসেছিলেন জর্জের বাড়িতে।
এর পরের দৃশ্যে জর্জ আর পেপিকে একসাথে
নাচতে দেখা গেল সবাক স্টুডিওতে। সামনে বসে সেই পরিচালক। জর্জের রূপান্তর দেখে
মুগ্ধ পরিচালক হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন ‘ওয়ান্ডারফুল’। এই প্রথম শব্দ করে কারো কথা শোনা গেল। শোনা গেল ইউনিটের অন্যান্যদের কথাও।
বোঝা গেল জর্জ সবাক পথে এলেন। মদন
তাঁতির মতো ভোর বেলা গাঁটের বাত ছাড়াতে, হাতের খিঁচ ছাড়াতে খালি খালি ‘ঠকাঠক
ঠকাঠক’ তাঁত চালায়নি।
আগেই বলেছি এ ছবির কাহিনি প্রায় চিরাচরিত
হলিউডি ছকে বাঁধা। আসল হলো এমন একটা বিষয় ভাবনা ও নিখুঁত উপস্থাপনা। কী অসাধারণ মুন্সীয়ানায় ও মমত্ত্বে নির্বাক যুগকে ফুটিয়ে তোলা
হয়েছে যা এককথা অবিশ্বাস্য। একদিকে নির্বাক যুগের প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধা যেমন ধরা
পড়েছে অন্যদিকে শিল্পকেও আধুনিক থেকে আরো আধুনিক পথে এগিয়ে যাওয়ার সশ্রদ্ধ বার্তাও
রয়েছে। অতীত থেকে বর্তমান কোনো সময়ের প্রতি এতটুকু অশ্রদ্ধা যেন না ধরা পড়ে সে
ব্যাপারে সদা সচেষ্ট থেকেছেন পরিচালক। ছোটো ছোটো প্রতীকী উপস্থাপনা অনন্য মাত্রা
দিয়েছে, যা বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভব নয়। যেভাবেই হোক দেখুন।
asadharon Dear Prodosh...need to read more and more your write ups...Thanks again
উত্তরমুছুনNitai Das
“দ্য আর্টিস্ট” এখনও দেখা হয়নি,আপনার রিভিউ পড়ে দেখার ইচ্ছা জাগল ।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ। অবশ্যই দেখুন।
মুছুনeti pore cinema ti dekhar probol icche jaglo
উত্তরমুছুনঅবশ্যই দেখুন।
উত্তরমুছুন