বাক্‌ ১১০ ।। এই সংখ্যার কবি ।। মাসুদ খান



মাসুদ খান

কবি, লেখক, অনুবাদক। জন্ম ২৯ মে ১৯৫৯, জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালে, পিতার কর্মস্থলে। পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জ। প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর। তড়িৎ ও ইলেকট্রন প্রকৌশলী। 

প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ম্যাগাজিনে, ১৯৭৯-তে। জাতীয় পর্যায়ে লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করে মধ্য-আশি থেকে, বাংলাদেশের বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও সাহিত্যপত্রিকায়।  পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন সাহিত্য-পত্রিকায় ও কবিতা-সংকলনে। 

ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ও রোমানিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা। লেখা প্রকাশিত হয়েছে Language for a New Century: Contemporary Poetry from the Middle East, Asia, and Beyond (W. W Norton & Co., New York/ London, 2008), Contemporary Literary Horizon Anthology (Romania, 2012), Intercontinental  Anthology of Poetry on Universal Peace (Global Fraternity of Poets Publishing, India, 2014) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংকলন, ম্যাগাজিন ও ওয়েবজিনে। 


প্রকাশিত গ্রন্থ

পাখিতীর্থদিনে (নদী, ঢাকা, ১৯৯৩)। 
নদীকূলে করি বাস (একুশে পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০০১)।
সরাইখানা ও হারানো মানুষ (একুশে পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০০৬)।
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি (ভাষাচিত্র, ঢাকা, ২০১১। হাওয়াকল, কলকাতা, ২০১২)।
এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায় (আড়িয়াল মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশনস, মন্ট্রিয়ল/ঢাকা, ২০১৪)।  
Poems of Masud Khan (Antivirus Publications, Liverpool, UK, 2014).
দেহ-অতিরিক্ত জ্বর (চৈতন্য প্রকাশন, সিলেট, ২০১৫)।
Carnival Times and Other Poems (in English and Spanish) (Bibliotheca Universalis,
 Bucharest, 2015).
প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান (চৈতন্য প্রকাশন, সিলেট, ২০১৬)।  


মাসুদ খানের একগুচ্ছ কবিতা


কৌতুকবিলাস 

ঈশ্বর ছুড়েছে ঢিল ঈশ্বরীর দিকে, কৌতুকবিলাসে। 

গ্রহটিকে মাটির ঢেলা বানিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের এক প্রান্ত থেকে
ক্ষেপণ করেছে ভগবান, অন্য প্রান্তে থাকা ভগবতীর প্রতি। 

মহাকাশ জুড়ে প্রসারিত মহাহিম শূন্যতা, লক্ষ-ডিগ্রি নিস্তব্ধতা-- 
তারই মধ্য দিয়ে একপিণ্ড ছোট্ট শ্যামল কোলাহল হয়ে 
ধেয়ে যাচ্ছে এই ঢিল। 

ঢিল নয়, মহামিসাইল-- 
মহাকাশের জোনাক-জ্বলা ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে
একের পর এক যমজাঙাল পেরিয়ে মিথ্যা-ইথারে অস্থির 
ঢেউ তুলে ছুটছে ঢিল অহেতু আহ্লাদে 
গোঁয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের মতো একদিকে টাল হয়ে চক্কর খেতে খেতে 
ঘোর-লাগা লাটিমঘূর্ণনে 
আহ্নিকে বার্ষিকে ধোঁয়াজট বেগব্যঞ্জনায়--  
যে বেগ উদ্ভ্রান্ত, যেই গতি একইসঙ্গে ঋজুরেখ বক্র চক্রাকার 
ঘূর্ণ্যমান নাটকীয় একরোখা দুর্ধর্ষ ও ওলটপালট...

ছুটতে ছুটতে হয়রান ঢিলখানি।
ওদিকে ঈশ্বরী, ওই রাঘবরহস্যে-ঘেরা উত্তুঙ্গ রহস্যরাজ্ঞী,
সর্বনাশা এক ভাব-আলেয়ার ভাব ধরে অজ্ঞাত স্থানকালাঙ্কে বসে  
থেকে-থেকে ছিনালি-হাতছানি একটু দিয়েই সরে যাচ্ছে দূরে।

মুহূর্তে মুহূর্তে ফুলে-ফেঁপে ওঠে মহাকাশ।
বেঁকে-যাওয়া, বাঁকতে-থাকা, ক্রমপ্রসারিত 
এক দেশকালের ভেতর দিয়ে ঘটতে থাকে 
ঢেলাটির উদ্ভ্রান্ত উন্মাদ ছুটে-চলা। আর 
ছিটকে পড়ার ভয়ে ভয়ার্ত শিশুর মতো ছুটন্ত ঢেলার গা আঁকড়ে ধরে 
চাম-উকুনের মতো চিমসা দিয়ে পড়ে থাকে প্রাণপণ 
তটস্থ ও অসহায় প্রাণিকুল।

খেলা করে ভগবান ভগবতী-- বিপদজনক ঢিল-ক্ষেপণের খেলা।
আর রোমাঞ্চে ও ত্রাসে শিউরে-শিউরে কেঁপে ওঠে তাদের শিশুরা।



দীক্ষা

পথ চলতে আলো লাগে। আমি অন্ধ, আমার লাগে না কিছু।

আমি বাঁশপাতার লণ্ঠন হালকা দোলাতে দোলাতে চলে যাব চীনে, জেনমঠে
কিংবা চীন-চীনান্ত পেরিয়ে আরো দূরের ভূগোলে। 
ফুলে-ফুলে উথলে-ওঠা স্নিগ্ধ চেরিগাছের তলায় বসে মৌমাছির গুঞ্জন শুনব 
নিষ্ঠ শ্রাবকের মতো, দেশনার ফাঁকে ফাঁকে। 
মন পড়ে রইবে দূরদেশে। সাধুর বেতের বাড়ি পড়বে পিঠে, 
দাগ ফুটবে সোনালু ফুলের মঞ্জরীর মতো শুদ্ধ সালঙ্কার...  

দীক্ষা নেব বটে মিতকথনের, কিন্তু
দিনে-দিনে হয়ে উঠব অমিতকথক, 
নিরক্ষর হবার সাধনা করতে গিয়ে আমি হয়ে উঠব অক্ষরবহুল
এই হাসাহাসিভরা ভুঁড়িটি ভাসিয়ে গল্প বলে যাব 
কখনো প্রেমের ফের কখনো ভাবের...
অথবা ধ্যানের, কিংবা নিবিড়-নিশীথে-ফোটা সুগভীরগন্ধা কোনো কামিনীফুলের। 

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরবে মঠের মেঘলা আঙিনায় 
ওদিকে অদূরে লালে-লাল-হয়ে-থাকা মাঠে পুড়তে থাকবে ঝাঁজালো মরিচ
সেই তথ্য এসে লাগবে ত্বকে ও ঝিল্লিতে।
আমি সেই মরিচ-পোড়ার গল্প বলব যখন--  
উত্তেজিত হয়ে তেড়ে গিয়ে যুদ্ধে যাবে সবে, এমনকি বৃদ্ধরাও।
যখন প্রেমের গল্প-- কমলায় রং ধরতে শুরু করবে সোনাঝরা নরম আলোয়।
আবার যখন গাইব সে-গন্ধকাহিনি, সেই ভেজা-ভেজা রাতজাগা কামিনীফুলের--  
ঘ্রাণের উষ্ণতা লেগে গলতে থাকবে মধুফল দেহের ভেতর।



স্বপ্নভূভাগ

এবার বলো হে ফিরতিপথের নাবিক, 
ওহে মাথা-মুড়ে-ফেলা ভিনদেশি কাপ্তান, 
সেই দ্বীপের খবর বলো 
যেইখানে মানিপ্ল্যান্ট ও সোলার প্ল্যান্টের পাতারা 
একযোগে চিয়ার্স-ধ্বনি তুলে পাল্লা দিয়ে 
পান করে রোদের শ্যাম্পেন। 
কোন প্রজন্মের উদ্দেশে তাদের সেই স্বতঃস্বাস্থ্যপান? 

সেই দ্বীপদেশের কথা বলো যেখানে নারীরা 
সামান্য একটি কাঠের কুটিরে 
ফুটিয়ে তোলে বাষট্টি রকমের বাৎসল্য ও প্রীতি। 

প্রীতিপরবশ সেই কুটিরের কথা বলো, সেই
একটানা মমতালোকের কথা বলে যাও হে কাপ্তান
যে-দেশে নিশুতি রাতে রাধিকাপুরের ঝিয়ারিরা 
পথ চলে শিস দিয়ে, তুড়ি বাজাতে বাজাতে। 
আর আশপাশের ঝোপঝাড় থেকে 
তালে-তালে পাল্টা তুড়ি বাজিয়ে সাড়া দেয় 
নবীন উলটকমলের চটপটে পাতা ও পল্লব। 

এবং হঠাৎই, টাশ-টাশ করে কথা বলে ওঠে 
তরুণী বনবিড়ালিনীর সদ্য-বোল-ফোটা কনিষ্ঠা মেয়েটি।
তাক লাগিয়ে দেয় দ্বীপদেশের অরণ্য অধ্যায়ে।   

নাবিক, অবাক সেই ভূভাগের কথা বলো  
যেখানকার মাটি উষ্ণ, অপত্যবৎসল, 
যেখানে মানুষ সোজা মাটিতে শুয়ে পড়ে  
শুষে নেয় অষ্টাঙ্গে ভূতাপশক্তি সঞ্জীবন... 
দেহ ও মাটিতে যোগাযোগ হয় একদম সরাসরি, 
সোজা ও সহজ। 

ও ফিরতিপথের নাবিক, ও মাথা-মুড়ে-ফেলা প্রবীণ কাপ্তান, 
তুমি সেই প্রসন্ন দ্বীপের কথা বলো, কী কী দেখলে সেখানে?  
জলবায়বীয় পরিস্থিতির কথা বলো
প্রাণী ও পতঙ্গদের উল্লোল উচ্ছ্বাস  
আর গাছেদের স্বতঃস্ফূর্তির খবর...

আমরাও তো চলেছি উজানে। 
চলছি তো চলছিই অনিঃশেষ
উত্তর পেরিয়ে আরো দূর উত্তরোত্তর অঞ্চলে... 
উগ্র লোনা বাতাসের সোহাগে, লেহনে    
বিকল হয়েছে আমাদের সেকসট্যান্ট 
মর্চে ধরেছে কম্পাসে, দুরবিনে। 
চলেছি তবুও।

বহু প্রত্যাশার, বহু সাধ-সাধ্য-সাধনার যোগ্য
স্বপ্নভূভাগ কি এরকমই দূর ও দুর্গম, যোগাযোগাযোগ্য?



জ্বরের ঋতুতে

তখন আমাদের ঋতুবদলের দিন। খোলসত্যাগের কাল। সুস্পষ্ট কোনো সর্বনাশের ভেতর ঢুকে পড়তে চেয়েছিলাম আমরা দুজন। তার আগেই তোমার জ্বর এল। ধস-নামানো জ্বর। তুমি থার্মোমিটারের পারদস্তম্ভ খিমচে ধরে ধরে উঠে যাচ্ছ সরসর করে একশো পাঁচ ছয় সাত আট...
ডিগ্রির পর ডিগ্রি পেরিয়ে...সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী তাপের সহগ হয়ে উতরে উঠছ তরতরিয়ে সেইখানে, যেখানে আর কোনো ডিগ্রি নাই, তাপাঙ্ক নাই...তাপের চূড়ান্ত লাস্যমাত্রায় উঠে ঠাস করে ফারেনহাইট ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছে থার্মোমিটারের ফুটন্তঘন বহ্নিতরল...

তীব্র, ধসনামানো জ্বরেও নারীরা ধসে না। হয়তো কিছুটা কদাকার দেখায়, এবং কিছুটা করালীর মতো। যত রূপসী তত করালিনী, জ্বরে। 

একসময় মাথা-ফেটে-যাওয়া থার্মোমিটারকে ব্রুমস্টিক বানিয়ে তাতে চড়ে উধাও উড়ালে অস্পষ্ট অঘটনের দিকে হারিয়ে যাচ্ছ হে তুমি, প্রিয়তরা পিশাচী আমার।

জীবনে প্রথম মুখোমুখি এরকম সরাসরি স্পষ্ট বিপর্যাস...
মিটারের জ্বালাখোঁড়ল থেকে ঝরছে তখনো টগবগ-করে-ফোটা ফোঁটা-ফোঁটা লাভানির্যাস।



ডালিম

যুগের যুগের বহু বিষণ্ণ বিবর্ণ মানুষের দীর্ঘনিঃশ্বাসের সাথে
নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইড-- 
তা-ই থেকে তিলতিল কার্বন কুড়িয়ে 
জমাট বাঁধিয়ে, কাষ্ঠীভূত হয়ে
তবে ওই সারি-সারি দিব্যোন্মাদ ডালিমের গাছ। 
বৃক্ষের যতটা সাধ্য, তারও বাইরে গিয়ে 
তবেই-না ওই টানটান বেদানাবৃক্ষ, ব্যাকুল বেদনাকুঞ্জ, 
মায়াতরু...রূপাঙ্কুর...রূপসনা তন...
পাতার আড়ালে ফাঁকে-ফাঁকে ফলোদয় 
থোকা-থোকা গুপ্ত রক্তকুপিত উত্তপ্ত বিস্ফোরণ
রামধনুরঙে, মগ্নছন্দে 
ফলিয়ে ফাটিয়ে তোলে ডালে-ডালে লালাভ ডালিম। 

বসে আছি ম্রিয়মাণ...বেদনাবৃক্ষের নিচে, পড়ন্ত বেলায়। 
সামনে খুলে মেলে-রাখা একটি ডালিমফল, তাতে
প্রভূত বেদানা-দানা, নিবিড় বেদনাকোষ...আর, 
বেদানার দানারা তো আর কিছু নয়, জানি--  
টলটলে করুণ চোখে রক্তজমা চাবুক-চাহনি...

ভাবি, 
এতসব ডালিমকোষের মধ্যে, ঠিক কোন কোষটি রচিত  
আমারই সে ন্যুব্জ ব্যর্থ বিষণ্ণ পিতার বাষ্পঠাসা দীর্ঘশ্বাসের কার্বনে!
ঘনীভূত হয়ে ওই বায়ব অঙ্গার, তিলে-তিলে, অনেক বছর ধরে...




ছক

দশটি পথ এসে যেখানটায় কাটাকাটি হয়ে চলে গেছে দশ দিগন্তের দিকে, সেইখানটায় গিয়ে বসে থাকেন আমার মা। পথের ধারে বসে মা আমার মানুষ দ্যাখেন, মানুষের আসা-যাওয়া দ্যাখেন। কোনো পথ দিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা। কোনো পথ দিয়ে আসে গ্রহণ-লাগা,
 ক্ষয়ে-যাওয়া, নিভু-নিভু সব বনি-আদমের দল। আবার মেঘ ও মিথুন রাশির ছায়ায় তুমুলভাবে বাঁচতে থাকা মানব-মানবীদের যাতায়াত কোনো কোনো পথে। 

একদিন আসা-যাওয়ার পথের ধারে মা কুড়িয়ে পেলেন আমার ভাইকে (আমি তখনো আসিনি আমার এই মায়ের কাছে)। কিন্তু কিছুকাল পর আমার সেই ভাই হঠাৎ গেল হারিয়ে। তারপর থেকে মা আমার ওই পথমোহনায় বসে তীব্র পুত্রশোকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন। 

একবার, গোধূলিরঙের লম্বা-লম্বা চুলদাড়িঅলা এক বুড়ো পথিক ক্ষণিকের জন্যে থামালেন তার পথচলা। মা-র কাছে সব শুনে বললেন, “কোথাও তো কিছু হারায় না মা এই মহাবিশ্বে! যাও খুঁজে দ্যাখো। তারপর থেকে মা আমার উড়ে উড়ে বিশ্বসংসার তোলপাড় করে খুঁজে ফিরেছেন 
তার সন্তানকে। শেষে সপ্ত-আকাশের পরপারে আমাকে কুড়িয়ে পেয়ে, এবং তার সন্তানকেই পেয়েছেন মনে করে, উড়িয়ে নিয়ে এলেন এই মর্ত্যের  ধুলায়। আমি তখন সাত আসমানের ওপারে অনন্ত নক্ষত্রকুঞ্জের ঝাড়জঙ্গলের ধারে সোনালি খড়ের গাদায় বসে অনাথ শিশুর মতো কাঁদছিলাম
 একা একা, মাকে হারিয়ে। 
দিন যাবে, মাস যাবে, ঘুরে আসবে বছর...
একদিন হয়তো আবার হারিয়ে যাব আমি এই নতুন পাওয়া মায়ের কাছ থেকে আর আমাকে খুঁজে পাবেন অন্য এক মা। তারও হারিয়েছে সন্তান। আমাকে পেয়ে ভাববেন, খুঁজে পেয়েছেন তারই হারানো ছেলেকে। 

এইসব অনন্ত বিভ্রম আর বন্ধন
এই যে নিখিল ভুলবোঝাবুঝি
লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদা আর হারানো-পাওয়া খেলা
এইসব নিরন্তর মায়া ও ম্যাজিক...
সবকিছু অমীমাংসিত রেখে দিয়ে,

কাটাকুটি ময়লা ডুপ্লিকেট নকশা একখানা জগৎসংসারের,
তা-ই মেলে ধরে অবাক উদাস হয়ে বসে আছেন জরিপকর্তা। 

নকশাটাতে একপাশে লেখা-- স্বাক্ষর/- অস্পষ্ট
নিচে তার চেয়েও অস্পষ্ট একটা সিল... 





বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা

মেঘ থেকে মেঘে লাফ দেবার সময়
তূরীয় আহ্লাদে দ্রুত কেঁপে-বেঁকে
একটানে একাকার যখন বিজলিসূত্র, ওই ঊর্ধ্বতন
মেঘের আসনে এক ঝলক দেখা গেল তাকে
আলোকিত ঘনকের আকারে।

তাকে ডাক দেব-দেব, আহা কী বলে যে ডাক দেই!
জন্ম এক রুদ্ধভাষ জাতিতে আমার-- 
মুহূর্তে মিলিয়ে গেল অপর আকারে।

দূর মহাকাশে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুটে আছে কত ফুয়েল-স্টেশন-- 
সেইসব এলোমেলো নৈশ নকশার মধ্যে তাকে, প্রিয় তোমাকেই,
ঘোর মধ্যরাতে
এইভাবে দেখে ফেলি আমিও প্রথম।
সর্ববায়ু আমার সুস্থির হয়ে যায়।

যেই দেখি আর ডাক দিতে যাই প্রিয়, অমনি
তোমার সমস্ত আলো, সকল উদ্ভাস
হঠাৎ নিভিয়ে নিয়ে চুপচাপ অন্ধকার হয়ে যাও।
আবার উদ্ভাস দাও ক্ষণকাল পরে-- 

এইরূপে খেলা করো, লুকোচুরি, আমার সহিত।
আমি থাকি সুদূর রূপতরঙ্গ গাঁয়, আর তোমার সহিত 
তোমারই সাহিত্যে আহা এভাবে আমার বেলা বয়ে যায়।

এরপর থেকে একে একে এক উচ্চতর জীবের বিবেক
প্রথমে প্রয়োগ করে দেখি,
মিলিয়ে যাচ্ছেন তিনি আকারে ও নিরাকারে।
এক অতিকায় জট-পাকানো যন্ত্রের
আগ্রহ সাধন করে দেখি,
তা-ও তিনি ছড়িয়ে পড়েন সেই আকারে নিরাকার;
আকাশে আকাশে মেলে রাখা তার কী ব্যাপক কর্মাচার,
একটির পর একটি গ্রহ আর জ্বালানি-জংশন সব
অতর্কিতে নিভিয়ে নিভিয়ে প্রবাহিত হন তিনি।

একদা মণ্ডলাকার ছিলে জানি
আজ দেখি দৈবাৎ ধর্মান্তরিত, ঘনকের রূপে!
ঘনক তো গোলকেরই এক দুরারোগ্য সম্প্রসার। 
তবুও তো ধর্ম রক্ষা পায়। রক্ষিত, সাধিত হয় তবু।

গোলকত্ব পরম আকার
গোলকতা যথা এক অপূর্ব বিহেভিয়ার, 
প্রায়-নিরাকারসম এক নিখুঁত আকার।

শৈশবের কালে, এক আশ্চর্য মশলা-সুরভিত
গুহার গবাক্ষপথে আচম্বিতে ভেসে উঠেছিল মেঘ,
যার বাষ্পে বাষ্পে কূটাভাস।
কিছুতেই পড়তে পারি নাই সেই মেঘ
আমরা তখন।

বিব্রত বাতাস তাকে, মেঘে মেঘে সংগঠিত ক্ষণ-ক্ষণ-আকৃতিকে,
ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে যাচ্ছে কত বিভিন্ন প্রদেশে।
নিরাকৃত হতে হতে প্রায়, ওই তো ব্যক্ত হচ্ছেন ফের আকারে আকারে।
ধর্মচ্যুত হতে হতে প্রায়, ফের প্রচারিত হন ধর্মে ধর্মে।
আহা, ধর্ম হারালে কী আর থাকে তবে এ ভুবনে!
ঘনক যে গোলকেরই এক নিদারুণ তাপিত প্রসার।

বৃহৎ, অকল্পনীয় এক জড়সংকলন। বড় বালিপুস্তকের মতো--
তারই মধ্যে অকস্মাৎ একটু প্রাণের আভা। মাত্র তার একটি পৃষ্ঠায়।
এই সংকলনের ভূমিকাপত্রটিও নেই। ছিন্ন। সেই প্রধান সংঘর্ষে।

নিষ্ক্রান্তিদিবসে, অতঃপর, ওই গুহামুখে পড়ে থাকে 
এ বিপুল জড়সংকলনের ছেঁড়া ভূমিকাপৃষ্ঠাটি,
অর্থাৎ সেই যে প্রথম ক্যাজুয়াল্টি, নিখিলের-- 
ওই গুহাপথে, নিষ্ক্রমণকালে।

একবার মাত্র দেখা হয়েছিল কায়ারূপে
ঝাপসা, ছায়া-ছায়া!
তা-ও বিজলির দিনে, তা-ও মেঘের ওপরে 
উল্লম্ফকালীন।
এরপর থেকে শুধু ভাবমূর্তি...
যেদিকে তাকানো যায়
কেবলই, উপর্যুপরি ভাবমূর্তি ঝলকায়।

মাঠে মাঠে স্প্রিং স্ক্রু আর নাটবোল্ট ফলেছে এবার সব জং-ধরা।
সে-সব ভূমিতে হাঁটু গেড়ে গলবস্ত্র হয়ে পরিপূর্ণ দুই হাত তুলে
যাচ্ঞামগ্ন সারি সারি সম্প্রদায়-- তারা অসবর্ণ, তারা
লঘিষ্ঠ-- কলহরত বিড়ালের আধো-আলো-আঁধারি বাচন ও কণ্ঠস্বর
কেড়ে নিয়ে দ্রুত নিজ কণ্ঠে কণ্ঠে গুঁজে দিয়ে সারিতে দাঁড়িয়ে যায় তারা।

তেজের অধিক তেজ
বাক্-এর অধিক বাকস্ফূর্তি তুমি,
গোলকে স্ফুরিত হয়ে এসো পুনর্বার
পূর্বধর্ম ধারণ করে সরাসরি উত্তম পুরুষে।

আর
কত অর্থ যে নিহিত করে রাখো বীজাকারে
সেইসব ভাসমান বাক্যের অন্তরে,
দৃশ্যত যা অর্থহীন অতি-অর্বাচীনদের কাছে।

সংকটে সংকটে, সর্ব-আকারবিনাশী
দহন দলন আর দমনের দিনে
আদিগন্ত কুয়াশা-মোড়ানো সেই তৎকালীন রৌদ্রের মধ্যেই
চতুর্দিক থেকে একসঙ্গে আর
বৃক্ষে বৃক্ষে আর দ্রব্যে দ্রব্যে আর ভূতে ভূতে সর্বভূতে
মুহুর্মুহু উদ্ভাস তোমার, এক অবধানপূর্ব রহিমের রূপে।
ঘনক তো গোলকেরই এক অপূর্ব অপিনিহিতি।

এইরূপে লীলা করো, লুকোচুরি, আমার সহিত।
আমি থাকি দূরের রূপতরঙ্গ গাঁয়, আর তোমার সহিত
তোমার সাহিত্যে দ্যাখো এভাবে আমার বেলা বয়ে যায়।




প্রলাপবচন

নদ এসে উপগত হবে ফের নদীর ওপর
দুই পারে জমে উঠবে কপট কাদার ঘুটঘুটে কেলেংকারি 
মাঝখানে চোরাঘূর্ণি চোরাস্রোত  
এলোমেলো এলোমেলো বাউরি ভাবনা এসে 
পাক খেয়ে ঢুকে পড়বে বৃষ থেকে মিথুনের অধিক্ষেত্রে। 

মাকাল ফলের মৃদু মনস্তাপ 
করলা-লতার শ্যামলা আক্ষেপ 
কোকিলস্য প্রবঞ্চনা, কাকের বাসায় উপঢৌকন 
ভরা বিলের ওপর দিয়ে ভেসে আসা ভেজা-ভেজা সুর
হুদহুদ পাখির অস্থিরতা, অসমাপিকার লঘু তঞ্চকতা 
একরোখা অশ্বের অস্মিতা, উগ্রবসনা আগুনের চঞ্চল রসনা... 
আলগোছে সবকিছু পাশ কেটে গিয়ে
ওইদিকে বর থাকবে কনের বশে 
খলনায়কের দাঁতের নিচে পড়বে কট্টরপন্থী কাঁকর 
চার্জ করা হবে পশ্চিমের ব্লাস্ট ফার্নেসে 
আর ঝাপটা এসে লাগবে পূর্বেরটা থেকে 
খামাখা দিওয়ানা হবে রঙিলা বিড়ালিনী
ঘনঘন গণ-হাইপ উঠবে মামুলি ঘটনা ঘিরে এমনি-এমনি
হিস্টিরিয়ায় কাঁপতে থাকবে দেশকাল  
সাত সাধু এক হবে, এক শয়তান সাত
দোষযুক্ত আলু নামবে হিমাগারের শ্রোণিচক্র থেকে... 

এবং হয়তো আমি একদিন ঠিকই
পড়ো-পড়ো ঘরকে যোগাতে পারব 
গাঁট-অলা তিন-বাঁকা শালকাঠের সমর্থন 
নিশ্চিহ্নকে দেখাতে পারব কিছু লুপ্তপ্রায় চিহ্নের ইশারা 
বিশেষকে কোনো ভ্রান্তিকর নির্বিশেষের আভাস 
বেদিশাকে দিশার বিভ্রম...

আর দুম করে লিখে ফেলব এমন এক কবিতা একদিন,
যা পড়ে ভৌতিক সুর তুলবে একসঙ্গে সাধু ও শয়তান 
সাপ-আর-অভিশাপে-গড়া মতানৈক্যে-ভরা গামারিকাঠের গিটারে
আর চলে আয়বলে খোদ খোদাতালা টুইট পাঠাবেন দিব্য টুইটারে।




   
দমকল

উন্মাদ উঠেছে গাছে, তরতর করে, ছাড়া পেয়ে পাগলাগারদ। 

নামে না সে কিছুতেই, যতক্ষণ-না ওই বেঁটেখাটো নার্সটি এসে 
মিনতি করে না-নামায় তাকে।

নার্স আসে দ্রুত, দমকলের মতন 
কী-কী যেন বলে হাত নেড়ে নেড়ে, 
তাতে খুশি হয়ে নেমে আসে উঁচু ডাল থেকে বিমুগ্ধ পাগল--  
ঝোলের উল্লাসসহ নেমে আসে যেইভাবে কইমাছ পাতে
কানকো টেনে টেনে  
ক্রমিক সংখ্যার মতো সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে।

ঝিলমিল করে বয়ে যায়, সেবিকার বোধে, পাগলের বিকল বিবেক। 

উন্মাদ আবার ফিরে যাবে আজ উন্মাদ-আশ্রমে
ধর্মগণ্ডিকায় মাথা রেখে নির্বিকার নিয়ে নেবে 
তেরোটি ইলেকট্রিক শক 
তেরোবার স্বীকারোক্তি, স্বাস্থ্যযাজকের শান্ত সুধীর নির্দেশে।




মা

এই ধূলি-ওড়া অপরাহ্ণে,
দূরে, দিগন্তের একেবারে কাছাকাছি
ওই যে খোলা আকাশের নিচে একা শয্যা পেতে শুয়ে আছেন--  
তিনি আমার মা।
দূর্বা আর ডেটলের মিশ্র ঢেউয়ে, ঘ্রাণে রচিত সে-শয্যা।
নাকে নল, অক্সিজেন, বাহুতে স্যালাইন, ক্যাথেটার--  
এভাবে প্লাস্টিক-পলিথিনের লতায় গুল্মে আস্তে-আস্তে
জড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি।

শয্যা ঘিরে অনেকদূর পর্যন্ত ধোঁয়া-ধোঁয়া
মিথ্যা-মিথ্যা আবহাওয়া।

মনে হলো, বহুকাল পরে যেন গোধূলি নামছে
এইবার কিছু পাখি ও পতঙ্গ
তাদের উচ্ছল প্রগলভতা
অর্বাচীন সুরবোধ আর
অস্পষ্ট বিলাপরীতি নিয়ে
ভয়ে ভয়ে খুঁজছে আশ্রয় ওই প্লাস্টিকের ঝোপঝাড়ে,
দিগন্তের ধার ঘেঁষে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা প্রাচীন মাতৃছায়ায়।

৪টি মন্তব্য: