বাক্‌ ১১০ : মাজহার সরকার




কবি

টেবিলের ওপর  পত্রিকা রেখে চেয়ার থেকে একটু সামনে ঝুকে সাহিত্য পাতাটা মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন লুতফর রহমান আজ শুক্রবার প্রায় সব কয়টি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী বের হয়েছে লুতফুর রহমান কোনদিন বাড়িতে পত্রিকা রাখেন না শুধু শুক্রবার এলে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কালীগঞ্জ বাজারে রিকশা আপ ডাউন নিয়ে আট দশটা পত্রিকা কিনে নিয়ে আসেন
আজও তার ব্যতিক্রম হলো না স্ত্রীর কথামতো আধা কেজি আলু, আড়াইশ’ গ্রাম রসুন ও একটা গুড়ো দুধের প্যাকেটও কিনে এনেছেন। রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগটা কোনরকম রেখে ফেলে এসে এখন পত্রিকা পড়ছেন লুতফর রহমান চশমার দুই দুইটা গ্লাসের ভেতর থেকে তার চোখের মণিদুটো বের হয়ে সেছে

সবগুলো সাময়িকী যে পড়া হয় তা নয় উল্টে পাল্টে চোখের দেখায় যা কিছু ভালো লাগে তাই পড়তে বসে যান তিনি কবিতা, সাহিত্য সমালোচনা, সাক্ষাতকার, অনুবাদ, গল্প কিছুই বাদ যায় না মাঝে মাঝে দুই দুই একটা মনমতো গল্প পেয়ে যান, সারাদিন বিরতি দিয়ে দিয়ে সেটা পড়েন তিনি একটানা পড়েন না লুতফর রহমান বিশ পঁচিশ লাইন পড়েই একটু দম নেন স্টিলের জগ থেকে পানি ঢেলে খান গলাটা উঁচিয়ে ঢকঢক শব্দে পানি খেতে গিয়ে দুই এক ফোঁটা এসে পড়ে গায়ে হাত দিয়ে মুছেন তিনি এইসব কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন মেঘ দেখেন পাখি দেখেন মেঘের ফাঁক দিয়ে পাখি উড়ে যাওয়া দেখেন ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার পত্রিকার পাতায় চোখ রাখেন

যেখানে ফেলে এসেছিলেন সেখান থেকে আবার পড়া শুরু করেন এভাবে ভেবে ভেবে পড়তে পছন্দ করেন লুতফর রহমান মাঝে মাঝে নিজের জীবনের সঙ্গে কিংবা আশপাশের কোন জীবন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল খুঁজে পান লেখার দেখা গেলোএকটা কবিতার লাইন বা গল্পের ক্ষুদ্রাংশ হুবহু মিলে গেলো তার এক টুকরো স্মৃতির সাথে  তখন খুব মজা পান লুতফর রহমান
সেদিন দুপুরবেলা মাঝখানের রুমটায় বসে সাহিত্য সাময়িকী পড়ছেন তিনি রুমের এক পাশের দরজা খোলা দরজার ওইপাশে একটু দূরে রান্নাঘর রান্নাঘরে লুতফর রহমানের স্ত্রী সানজিদা বেগম রান্নাবান্না করছেন তেলভরা গরম কড়াইয়ে সবজিটা ঢেলে দেওয়া মাত্র ধোঁয়ায় ভরে গেলো ঘর মশলা মরিচ আর পেঁয়াজের ঝাঁঝে গমগম করে উঠলো বাতাস লুতফর রহমান চেয়ারে বসেই মশলা আর ধোঁয়ার ঝাঁঝে খুকখুক করে কাশেন খুক খুউক খুক।
একবার চেয়ার থেকে পিঠটা বাঁকা করে গলা উঁচিয়ে উঁকি দিয়ে রান্নাঘরে দেখেন
-কি হলো! এতো ধোঁয়া কিসের শুনি! আগুন রান্না করছো নাকি!
সানজিদা বেগম রান্না রেখে ডাল ঘুটনি হাতে নিয়ে ফোঁস করে ওঠে। বলে, একবার তুমি এসে রান্না করো দেখি! চেয়ারে বসে বসে জ্ঞান দিও না!
লুতফর রহমান হু খুক খুক খুউক উহুক করে ওঠেনফিসফিস করে বলেন, শিল্প সাহিত্য বিবর্জিত মানুষ! একজন শিল্পীর সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানে না।
-কী? কী বললে তু্মি? আরেকবার বলো দেখি! সারাদিন কী ছাইপাশ পড়ে বেড়াও, এইসব পড়েই তোমার মাথাটা নষ্ট হয়েছে। সংসারের খোঁজ রাখো? কবিতা ভাত দেবে তোমাকে?
-ছাইপাশ বলো না। এগুলো সব প্রধান কবির লেখা, জাগতিক সব চাওয়া পাওয়া ফেলে তারা সমষ্টির কথা ভেবে ভেবে লিখেন।
-থাক থাক! খুব বুঝেছি। ঘরে এক দানাও লবন নেই। শার্টটা গায়ে দিয়ে একটু বাজারে যাও।
-কি বলো, এইমাত্র না বাজার থেকে এলাম!
-তখন দরকার ছিলো না। এখন দরকার পড়েছে। এখন বাজারে যান তিল্পী!
-কি বলো এসব? একজন শিল্পীকে তুমি তিল্পী বললে! তুমি জানো তারা কতো সংবেদনশীল হয়?
-না জানি না। আমার এসব ছাই জানার দরকার নেই। আমার লবণ দরকার।
সানজিদা খাতুনের গলাটা আরেকটু চড়া হয়।  কথার তীব্রতায় গলার রগ দুইটা ফুলে উঠে। হাতের পেশিতে মুখটা মুছে, শাড়ির আঁচলটা আরেকবার সামনে টেনে ধরে কড়াইয়ে চামচ চালান তিনি।
­        সেদিকে আর মনোযোগ না দিয়ে আরেকবার কেশে নিয়ে লুতফর রহমান পড়ার চেষ্টা করেন গোপীপুর হজরত লেনের ক্লিন্ন নর্দমা, এই অন্ধকার গলি আর আড়াই কুঠুরি চাপা ঘরের সব বিষন্নতা যেন তার প্রসন্ন উজ্জ্বলতায় ধুয়ে মুছে দিয়ে গেছে। কেননা  আজ একটা ভালো কবিতা পাওয়া গেলো আজ এটা পড়ে আর ভেবে ঘণ্টাখানেক সুন্দর সময় কাটানো যাবে।
লুতফর রহমান প্রায়ই বিভিন্ন দৈনিকে, লিটল ম্যাগে, ঈদ সংখ্যায় তার লেখা পড়েন খুব নামকরা কবিঅধ্যাপকেরা লিখেন তাকে বলেন প্রধান কবি। আফজাল হোসেন। গেলো বছরই একুশে পদক পেলেন। কবিতা, কথাসাহিত্য, সাহিত্য সমালোচনা সব ক্ষেত্রেই সমান বিচরণ তার।  তার লেখার ভক্ত লুতফর রহমান। লুতফর রহমান নিজে খুব লেখালেখি করেন না, কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকেই পড়েন। নিজেকে শিল্পী ভাবতে পছন্দ করেন। ভবানিপুর স্কুলের সাবেক কৃত্তিছাত্র লুতফর রহমান একবার আবৃতি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে বই পুরস্কার পেয়েছিলেন। বহুদিন ধরে সেই বইগুলো বুকে নিয়ে ঘুমোতে যেতেন লুতফর রহমান। সেই থেকে তার বইপ্রীতি, সাহিত্যপ্রীতি।

লুতফর রহমান ঠিক করলেন এইবার তার প্রিয় কবি আফজাল হোসেনের সঙ্গে তিনি দেখা করবেন সেই বছর বিশেক একবার তাকে চিঠি লিখেছিলেন এখন তো চিঠির যুগ নেই ইমেইল আর ফেসবুকের যুগ আফজাল হোসেন চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন, একটা ঠিকানা দিয়ে ঢাকায় গেলে দেখা করতে বলেছিলেন সেই ঠিকানা কাগজে যত্ন করে লিখে রেখেছেন তিনি। তারপর অনেকবার ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন লুতফর কিন্তু প্রিয় কবির সঙ্গে দেখা হয়নি এবার শুধু তার সঙ্গে দেখা করতেই ঢাকায় যাবেন লুতফর যে কথা সেই কাজ

ব্যাগে কিছু বইও নিলেন তিনি আফজাল হোসেনই বই, সেগুলোতে অটোগ্রাফ করিয়ে আনতে হবে সঙ্গে নিলেন নতুন পুরোনো কিছু পত্রিকা কাটিং। আফজাল হোসেনকে দেখাতে হবে তার কি পরিমাণ ভক্ত তিনি। নিজের লেখা কিছু কবিতাও নিলেন। পত্রিকায় একটা সাক্ষাতকারে পড়েছিলেন প্রিয় কবির প্রিয় খাবার হলো গুড়ের পায়েস। তাই এক থাল পায়েস ভালো করে প্যাকেট করে নিলেন। রওয়ানা দিলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে।
পাশের বস্তির হনুফা ও আকলিমা আবার ঝগড়া শুরু করেছে একে অন্যের চুল টেনে মাটিতে ঠুসে দিয়ে প্রাণপণে হারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তারা গালি গালাজের তুবড়ি ছোটে কেউ এসে থামায় না লুতফর রহমান ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন বলেন, শিল্প সাহিত্য বিবর্জিত মানুষ তো এমনই করবে!  পাশ থেকে কে যেন শোনে ফেলে কথাটা, বলে- তিল্পী তিল্পী। লুতফর রহমান চকিত ফিরে বলে- কে? কে শিল্পিকে তিল্পী বলে। জানো না শিল্পীরা সংবেদনশীল মানুষ!

বারিধারায় ৯ নাম্বার লেনের ৩৪ নাম্বার বাড়ির গেটে গিয়ে দাঁড়ান লুতফর রহমান। কাগজে লেখা ঠিকানার সাথে মিলিয়ে দেখেন। হেঁটে যাওয়া এক পথচারীকে পেয়ে বলেন, ভাই এটাই কি কবি আফজাল হোসেনের বাড়ি? পথচারী বলেন, আমি এই এলাকার নই চাচা।  লুতফর রহমান মনে মনে বলেন, তা জানবে কি করে! কবির বাড়ি চেনো না শিল্প বিবর্জিত মানুষ!  এর মধ্যেই দারোয়ান গেট খুলে দিলেন, একটা পাজেরো গাড়ি বের হলো ভেতর থেকে। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, গাড়ির মধ্যেই তো কবি আফজাল হোসেন! লুরফর রহমান গাড়ির পেছন পেছন দৌড়াতে থাকেন। গাড়ি থামে, গ্লাস উঠে।
এইতো, এইতো সেই প্রার্থিত মানুষ। লুতফর রহমান হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলেন, কবি! আমি আপনার ভক্ত। সেই যে লুতফর রহমান। গোপীপুরের, চিনতে পেরেছেন? বলতে বলতে বছর বিশেক আগে তার কাছে লেখা আফজাল হোসেনের চিঠিটা মুখের কাছে মেলে ধরেন তিনি।  আফজাল হোসেন বলেন আসেন আসেন গাড়িতে উঠে বসেন, আমি একটু বাজারে যাচ্ছি।

গাড়ি চলতে থাকে। লুতফর রহমান কি করে বুঝাবেন এই নতুন ঝকঝকে গাড়িতে বসে তিনি স্বস্তি পান না। গাড়ীর মসৃণ গতি, আদুরে বেড়ালের মতো তুলতুলে গদি, সামনে ঝুলানো গোলাপী রঙের বিদেশী পুতুল। ওই পুতুলের মতো লুতফর রহমানের নিজেকে খাঁচায় বন্ধী এক মানুষের মতো মনে হয়। ব্যাগ থেকে আফজাল হোসেনের প্রথম কবিতার বই ‘তুমি এসে অন্ধকার মুছে দাও’ বইটি খোলেন।  প্রধান কবি বইটি দেখেই চমকে উঠেন। আরে! এই বই আপনার কাছে এখনও আছে? কতোগুলো এডিশন হলো, কিন্তু প্রথম প্রিন্টাটা আমার কাছেও নেই! লুতফর রহমান এবার একটু লজ্জা পেলেন। কি যে বলেন কবি! বলতে বলতে ব্যাগ থেকে পত্রিকার কাটিংগুলো বের করতে থাকেন। আফজাল হোসেন বলেন, থাক থাক। লাগবে না, বুঝেছি।
-বইয়ে একটা অটোগ্রাফ দিন প্লিজ।  এই সপ্তাহে দৈনিক খবরবার্তায় আপনার ‘বিকেল একটা ক্লান্ত নারীর শরীর’ কবিতাটা পড়লাম।  তিন কুড়িবার পড়েছি বলতে পারেন।
-হ্যাঁ, কবিতাটা বেশ সাড়া পেয়েছি।  তা আপনি কি করেন?
-কবি, আমি একটা সরকারি চাকরি করতাম। এখন রিটায়ার্ড। পেনশনের টাকা দিয়েই চলে। ছেলেমেয়ে নেই।
-দেখুন আমি এখন কাঁচা বাজারে যাবো। ঘরে আমার স্ত্রী ছাড়া কেউ নেই। বাজার আমাকেই করতে হয়। কাজের ছেলে ছোকরাকে দিয়ে বাজার করানো আমার স্ত্রী একদম পছন্দ করেন না।  তারপর আমার ছেলেটা আজই আমেরিকা থেকে আসবে, সিটিজেনশিপ পেয়ে গেছে সে। তাকে আনতে এয়ারপোর্টে যেতে হবে।
-ও আচ্ছা। তা তো করতেই হয়।  আপনিও কি চলে যাবেন আমেরিকা?
-তা তো যেতেই হবে। আমার মেয়েটাও আমেরিকা থাকে। তার স্বামী নামকরা ইঞ্জিনিয়ার।  এই দেশের কোন ভবিষ্যৎ নেই বুঝলেন। জীবনের শেষ কটা দিন ছেলেমেয়ের সঙ্গেই থাকতে চাই।
 লুতফর রহমান হু হা করতে থাকেন। কাঁচা বাজারে আলু, পেঁয়াজ, পুঁইশাক, বোয়াল মাছ, আদা, দারুচিনি নানা জিনিস কেনাকাটা করে আবার গাড়িতে উঠেন তারা। একটু সুযোগ পেয়ে ব্যাগ থেকে নিজের লেখা একটা কবিতা আফজাল হোসেনের হাতে দেন লুতফর রহমান। দেখুন তো কবি, কবিতাটা কেমন হলো? বলেই লুতফর রহমানের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে লজ্জা উঁকি দিলো।  আফজাল হোসেন কয়েক মুহূর্ত কবিতাটা আঙুলে চেপে ধরে পড়ে নিয়ে বললেন, কলেজ বালকদের কবিতা হয়েছে এটা। আপনার ছেলে লিখেছে? লুতফর রহমান আকাশ থেকে পড়লেন। না না কবি, আমিই লিখেছি। খুব একটা লিখি না আমি। চেষ্টা করি মাত্র। আফজাল হোসেন বললেন, সবার লেখার প্রয়োজন নেই। সবাই লিখতে বসলে পড়বেটা কে?
লুতফর রহমানের বুকে একটা মোচড় দিলো। কিন্তু ঘাবড়ালেন না।  গাড়ি ৯ নাম্বার লেনে ঢুকতেই আফজাল হোসেনের মোবাইলে কল এলো একটা।  আফজাল হোসেন  মোবাইল রেখে ড্রাইবারকে বললেন, এই গাড়ি থামাও। থামাও। পাশের দোকান থেকে একটা লবণের প্যাকেট নিয়ে এসো তো! একজন শিল্পীর সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানে না মানুষ, উফ! লুতফর রহমান কবির কথা শুনেই বুঝতে পারলেন স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।  সানজিদা বেগমের কথা মনে হলো তার। এক প্যাকেট লবণের জন্য তাকে সেদিন বোকাটাই তাকে দিলো সেদিন। আফজাল হোসেনও কি লবণের জন্য! তাকেও বাজার করতে হয়! কবিও নায়-খায়, দুপুরে ভাতঘুম দেয়, মলমূত্র ত্যাগ থেকে যৌনক্রিয়া, সন্তান পালনে ব্যস্ত থাকেন
লুতফর রহমানের বুকে সানজিদা বেগমের হাত সানজিদার পাঁচটি আঙুল গাছের শেকড়ের মতো নিবিড় চালে লুতফর রহমানের বুকে গেঁথে যাচ্ছে, যে গাছ ফুল ও ফলে তার ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত জীবনটাকে জিউয়ে রেখেছে গত পঁয়ত্রিশটি বছর


                                                                         (চিত্রঋণ :  Sabin Balasa)

২টি মন্তব্য: