বাক্‌ ১১০ : শাহনাজ নাসরীন



।। গুম্‌ ।।

লোকটির দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সুজন। ফর্সা পাজামা পাঞ্জাবী, পাম্প শু। পাঞ্জাবীর ওপরে হাতকাটা কালো কোট যা মুজিব কোট নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে। লোকটি একটি পাইপও চাপিয়ে রেখেছে ঠোঁটের কোণে। ম্যানেজ করতে পারছে না। দেখলেই বুঝা যায় প্রাণপণে অনুকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সুজন হাসে। ব্যর্থ চেষ্টা বলাই বাহুল্য। কালো বেঁটে এই লোকের বঙ্গবন্ধুর আদল পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু সে হতবাক অন্য কারণে। কারণটি হলো এ তার বাপ কৃষক সংগঠক জব্বার মিঞা। যে কিনা কৃষকদেরকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি বয়স্ক শিক্ষা, নারী শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে গ্রামের চেহারাই পাল্টে ফেলতে চেয়েছিল।  এতকাল পরে এই লোক কোত্থেকে এলো সে কিছুতেই বুঝতে পারে না। আর এই ধোপদুরস্ত পোষাক, ঠোঁটের কোনে পাইপ! জ্যৈষ্ঠের কাঁঠাল পাঁকা গরমে পাঞ্জাবীর ওপরে একটি মুজিব কোট চাপিয়ে দরদর করে ঘামছে ঘটনাটা কী!
প্রশ্নটি ঠোঁটের ওপর এসেও থমকে দাড়ায়। তার বাপ তাকে দেখছে চোরা চোখে। মুখে লাজুক হাসি। বাবার মুখের ওপর স্থির চোখ ফেলে সে। এই লাজুক হাসিটি ছাড়া কিছুই যেন মিলছে না। স্মৃতির এপাশ ওপাশ জুড়ে  যে জব্বর আলী হেঁটে বেড়ায়, তার খালি গা, পরনে শুধু একটি চেক লুঙ্গি তাও গুঁজে হাটু পর্যন্ত তোলা। কানের ওপর সবসময় একটি বিড়ি রেখে দিতো। যেখানে আগুন পেতো ধরিয়ে কয়েকটি সুখটান দিয়ে নিভিয়ে ফেলতো। এভাবে কয়েকবারে একটি বিড়ি শেষ হলে লুঙ্গির খুট থেকে আরেকটি বের করে আবার কানে গুঁজতো।
খালি পায়ের গোড়ালি দুটোতে সারাবছর জৈষ্ঠ্যের ধানক্ষেতের মতো বড় বড় ফাঁটা। তাতে কালো কাদা জমে থাকতো। শেষ বিকেলে ক্ষেত থেকে ফিরে পুকুরঘাটে যখন ধুন্দুলের ছোবা ঘষে ঘষে পা পরিষ্কার করতো ফাটাগুলো থেকে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়তো। সুজন রক্ত দেখে ভয় পেলে বলতো চাষীর পোলার এত ভয় কইরলে চলব? এগুলি মাটির মায়ারে বাপ। মাটি হইল গিয়ে চাষীর মা। সে আমাগেরে জড়ায়ে রাখে তার পরাণে। তার বুক চিড়িয়া আমাগেরে দানা খাওয়ায়।
সুজনের মনে পড়ে তার বাপটা ছিল ভাবুক ধরণের। মাটির মায়ার কথা বলতো কিন্তু বাপেরও ছিল মাটির জন্য অফুরন্ত মায়া। মা যখন নিজের বানানো ওষুধ বাপের মাটি খাওয়া পায়ে লেপে দিতো তখন ঝংকার তুলে খোঁটা দিতো একজোড়া স্যান্ডেল কিনোনের ক্ষ্যামতা নাই আপনের? না থাইকলে আমারে কন বাপের বাড়িরতে নিয়া আসি।
সুজনের বাবা এর উত্তরে কিছু বলতো না লাজুক হাসতো শুধু।
সুজন মায়ের কাছে শুনেছে মায়ের শাশুড়ি অর্থ্যাৎ সুজনের দাদী বিভিন্ন সময়ে মায়ের বাপের বাড়ি থেকে এটা ওটা আদায় করেছে। বাপ পছন্দ করতো না মায়ের এ আচরণ কিন্তু মাকে কিছু বলতেও পারতো না। তাই শাশুড়ির মৃত্যুর পর তার মাও ভালমানুষ স্বামীকে এভাবে খোঁটা দিতো সুযোগ পেলেই। কিন্তু সুজনের মা যেমন জানতো সুজনও জেনে গিয়েছিল খালি পায়ে ক্ষেতে হাঁটা সুজনের বাবা ছাড়বে না।
সুজনকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে জব্বর আলী বলে, কিরে বাজান এতদিন পরে দেখা তো কাছেও ডাকো না বসতেও কও না?
সুজন একটু থমকায়। বাপ তাকে তুমি কেন বলছে! পরক্ষণে জিজ্ঞেসই করে ফেলে আমারে তুমি বলতেছেন?
এখন বাপমায়েরা পোলাপাইনগো তুমি বলে শুনলাম। তুইতোকারি করন নাকি ঠিক না?
সুজন হো হো করে হাসে। তার বাপের ভাষাও বদলেছে। আঞ্চলিক ভাষা ছেড়ে প্রমিত বাঙলায় কথা বলার চেষ্টা করছে।  সে ভাবে এতোদিনের যোগাযোগহীণতার পর সে এখন কোন ভাষায় কথা বলবে বাপের সাথে। তারপর হাসতে হাসতেই বলে আমি তো আর আপনের এখনের ছেলে না। আমারে আগের মতো তুই-ই বলেন।
জব্বার আলীও হাসে। ভুল বুঝতে পারলে শোধরানোই তো ভালো বাজান। ভুল শোধরাইলে ভালো না পারলে ভুল স্বীকার গেলেও দোষ নাই; দোষ হইল ভুল টাইনা বেড়ানো।
বাপের দার্শনিকতায় সুজন তেমন চমৎকৃত হয় না যেমনটা হয়েছিল পোশাক দেখে। সাধারণভাবে নরমসরম মনে হলেও বাপ যে নিজস্ব একটা দর্শন নিয়ে চলতো আর সেখানে যে সে একরোখা এটা তো সারাজীবন দিয়েই সে জানে। মনে মনে এখন  বাপকে প্যাঁচে ফেলার ফন্দি আঁটে সে। নীরিহ মুখে বলে, তো আপনে যে এই গরমে পাঞ্জাবীর উপরে কোট পইরা ঘুরতেছেন এইটা কি ভুল না? তাছাড়া আরেকজনের নকল কইরা সাজ পোশাক করনও কি ঠিক?
জব্বর আলী গর্জে ওঠে, নকল! কী কইতে চাস তুই? লেবাসটাই দেখলি? আমরা কি তার নামে যুদ্ধ করি নাই? তারে নেতা বলি নাই? পিতা মানি নাই?
মানছিলেন। আপনে মানছিলেন । মনে আছে তাঁরে হত্যার খবর শুইনা আপনে চিৎকার করতে করতে বাইর হইতে গেলে মা আটকানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারে নাই। তারে ধাক্কা দিয়া ফালায়া থুয়া গেছেন। সেই যে আপনে গেলেন এরপর সেই এতিম সংসারের উপ্রে দিয়া কী গেছে আজ আর সেই কথায় ফায়দা নাই।
তোমাগোর কাছে আমি অপরাধী বাজান । কিন্তু তবু তো সংসার চলতেছিল তোমার মায়ের গুণে। সে তো তোমাগোরে ...
, মা অকথ্য কষ্ট করছে। তবে মা সবসময় ঐ দুর্ভাগ্যের জন্য আপনের বুদ্ধিহীনতারে দায়ী করছে।
কী জানি বাজান  তোমার মায়ের কথাই ঠিক হয়তো।
কিন্তু আমি কখনও মনে করি নাই আপনে ভুল করছিলেন।
আমিও তো মনে করি নাই। কিন্তু আজকে তোমার অবস্থা দেইখা ভাবি ভুল না হইলে তোমার এমন হইল ক্যান?
হ বাপজান আপনের দায় আছে আমার এই অবস্থার পিছনে।এসই অল্প বয়স থিকা সারাজীবনে সবসময় আমার পিছ পিছ ঘুরছে সন্দেহের  চোখ। সেইটা আমার দোষে না আপনের কারণেই। আপনে বিদ্রোহ করছিলেন আপনের সন্তানও তাই সন্দেহজনক হইয়া গেল। কখন কী কইরা ফেলি সেই ভয় তাগো।
ভয় তো অমূলক ছিল না। প্রতিবাদ তো তুমি করতাই। কম্যুনিস্টও হইলা পরে তবু তুমি আমার সুসন্তান বাপ। কোনোদিন লোভের ফাঁদে পা দেও নাই, আমার নাম ভাঙ্গায়া সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা কর নাই।
এখন আর এইটা কোনো গুণের কথা না বাপজান। এই কারণে যখনই কোনো পরিবর্তনের হাওয়া লাগছে আমারে ধইরা নিছে। একপক্ষ সন্দেহ করছে তাগো সাথে আপোষ করি নাই বইলা আরেকপক্ষ অপছন্দ করছে তাগো সাথে ঝাঁকের কৈ হইয়া মিলামিশ্যা যাই নাই বইলা। এখন দেখেন কী হাল আমার।
কিন্তু তুই কম্যুনিস্ট হইতে গেলি ক্যান বাজান? এইরম গরমে জানালা ছাড়া ঘরে তুই.......
বাপের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুজন হাঁপায়, আপনেও কি কম্যুনিস্ট না? গরীব মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করেন নাই? এইসব বলতে গিয়াই তো আমি গুম হয়ে গেছি। আর কাউরে কোনোদিন দেখতে পামু না।
হ রে বাজান তোর অবস্থা দেইখাই তো থাকতে পারলাম না।
আসছেন ভালো হইছে। আপনের সাথে দেখা হইল খুবই ভালো লাগতেছে। কিন্তু বাজান সত্য কথা আমি কমুই। আপনের এই লেবাসবৃত্তি আমার ভালো লাগতেছে না। যে আপনে চাষী বইলা গর্ব করতেন, খালি পায়ে হাঁটতেন মাঠের পর মাঠ সেই আপনে বাজান নেতার আদর্শরে যে কি না নিজ ধর্ম মানছেন, প্রাণে ধারণ করছেন সেই আপনেরে আজ তা প্রমাণ করতে লেবাস নিতে হইল! এইটা ভুল ভুল ভুল!
জব্বর আলী এবার আর রাগ করে না। ম্লান হাসে। তারপর নরমভাবে বলে, আমার সাথে এমন রাগ দেখাইতেছস বাপ, কিন্তু এইটা খেয়াল করতেছস না যে আমি এখন শীত, গ্রীষ্ম, ভুল, শুদ্ধ সবের ঊর্দ্ধে। আমারে টানাটানি করা  আরেকটা ভুল। এই ভুলগুলি তো তোদেরই শোধরানোর কথা আছিল। কিন্তু তোরা কী করলি কদি? নতুন নতুন ভুল পয়দা করলি, ভুলেরে টাইনা টাইনা লম্বা করলি, ভুল নিয়া খেললি ভুলভুলানি খেলা এখন যে ভুলে ভুলে সয়লাব হয়া গেল সব.....
        এইটা আমাগো ভুল না বাজান আপনেগো সময়ের ভুল। সেই ভুলের বলি আমি আর আমরা। আপনেরে কখনো ভুল মনে করি নাই সত্য কিন্তু আপনেগো সময়ের ভুল আজকের এই ভুল সময়ের জন্য দায়ী। আপনেরা ব্যাক্তি পুঁজায় মাইতা ছিলেন লক্ষকোটি মানুষ বাদ দিয়া। তাগো দুঃখ-কষ্ট, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আশা-আকাঙ্খা কিছুই আপনেগো গোনাগুনতির মধ্যে আছিল না।
       সুজন চিৎকার করে ওঠে শোনেন বাপজান, যতই গুম করা হউক আমাগো চল্লিশ কোটি চোখ সব ঘুমায়া নাই। তারা দেখতেছে। তাগো নিখাদ দেশপ্রেমরে প্রশ্নবিদ্ধ কইরা স্বাধীনতারে ক্যাশ করার যে সংস্কৃতি চলতেছে তার কোনো ক্ষমা নাই ক্ষমা হইব না।
       তীব্র ব্যথায় ককিয়ে উঠে চোখ খোলে সুজন। পেটের মধ্যে রাইফেলের নল গেঁথে আছে। চোখ খোলার সাথে সাথেই একটি বুট আর খিস্তি একসঙ্গে আছড়ে পড়ে ঐ খানকির পুত ষাঢ়ের মত চিল্লাইতেছস ক্যান ? এত প্যাদানী খায়াও গলার জোর কমে নাই তোর? চল শালা অস্ত্র উদ্ধার করতে, খাসী করামু তরে আইজ, দেখি তোর গলার তাকত কত...

                                                               
                                                                                                                           (চিত্রঋণ : Thomas Kluge)

1 টি মন্তব্য:

  1. এই গল্পটা অন্যভাবে পড়লাম। প্রথমে সামনের অংশ, তারপর শেষেরটুকু। সবশেষে অন্তরা। সঙ্গীতের মতই কিন্তু। কিছুটা করুণ সুর। তবে, বেহালা নয়, সরোদ মনে হল যেন। ভাল লাগল।

    উত্তরমুছুন