বাক্‌ ১১০ ।। পুনরাধুনিক ভাবনা ও কবিতাগুচ্ছ ।। প্রমিত পণ্ডিত




পুনরাধুনিক ভাবনা

এক...


Alan Turing নামটার সাথে পরিচয় আছে?

নাহ্, তিনি পোস্ট-মডার্ন, নতুন কিংবা পুনরাধুনিক কবিতা লেখেননি, এমনকি তিনি  প্রতিকবিতারও কেউ নন সে অর্থে। Alan Turing হলেন সেই ভদ্রলোক, Enigma-র দুর্বোধ্যতম কোড যার সাথে লুকোচুরি খেলত, যিনি তাঁর প্রতিভার অসামান্যতায় শেষমেশ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন Enigma ডিকোড হবার প্রবল অসম্ভাবনাকে। কিন্তু পাঠক, তার আগে অবধি কি Turing নিজেও পুড়ে যান নি, লুকোচুরির সেই আলোছায়াময় অস্থিরতায়?


সুনীল,শক্তি,মলয়,অলোক,জয়,সুবোধ,অনুপম... পাঠ ও সামান্য হোমওয়ার্ক করে যখন কবিতাটা লিখতে এলাম, তখন আমার আঙুল, কলমের প্রতি অনেকটা এরূপ অস্থিরতাই রাখত।  কারণ,থিওরি-স্টাইল-দল সব মিলিয়ে আমার সামনে তখন অনেক সেন্সর,অনেক সম্ভাবনা...

আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না (এখনও কি সম্ভব কোনো কবিতারসিকের পক্ষেই!), ‘শিশুতীর্থ’ ছুড়ে ফেলে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ বুকে জড়িয়ে ধরা কিংবা উল্টোটা। একরৈখিকতা আমার স্বভাবধর্ম নয়, বেশ বুঝতে পারছিলাম...

এখানে বলে রাখা ভালো,আমার প্রথম সাহিত্যকর্ম ছিল প্রেমপত্র। শেলি-রুমি-বুকোয়স্কির চোটে তার প্রায় ওষ্ঠাগত প্রাণপ্রতিক্রিয়াটাও ছিল একটা দারুণ থাপ্পড় আমার সেই শিল্পপ্রচেষ্টাটির গালে-“এখানে অনেক ভালো ভালো কথা আছে প্রমিত,কিন্তু তোর নিজের প্রায় কোন কথাই নেই থ্যাঙ্ক গড, আমার প্রথম প্রেমিকা আমাকে ছেড়ে গেলেও ওর ওই কথাটা আমাকে এখনও ছেড়ে যায় নিভাগ্যিস




দুই...

লেখালেখিটা সিরিয়াসলি নেবার পর প্রথম যে বাউন্সারটা আসে, সেটা হল আমার লেখার স্টাইল কী রকম হবে বা আদৌ নিজস্ব কোনো স্টাইলের দরকার আছে কিনা।

এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে যারা নিজের স্বরহীনতাকে ঢাকতে চান অরিজিত সিং কিংবা শ্রেয়া ঘোষালের গানের বিভিন্ন ধরণের রেফারেন্স টেনে, তাদের স্মরণে রাখা ভালো,রবীন্দ্রনাথেরও কৌতুকবোধ প্রবল ছিল,কিন্তু তিনি কোনভাবেই একজন কপিল শর্মা নন। সমঝদারোকে লিয়ে ইতনা ইশারা হি কাফি হ্যায়!

তবে কি একজন কবির প্যাটার্ন, ছন্দবোধ ও অন্যান্য অওজারের ব্যাবহার আজীবন অপরিবর্তনীয় থাকবে? এর উত্তর,স্পষ্টতই না। তাঁর কবিতার ভাষা ও ধরণ অবশ্যই সদাজায়মান ও সঞ্চরণশীল হবে, তবে সেটা হতে হবে তাঁর নিজের জীবনবোধের সাপেক্ষে। তিনি ‘দেশ’-এর জন্য এক,আর ‘কৌরব’, ‘বাক্’, ‘নতুন কবিতা’ -এর কথা ভেবে আরেক ভাষা অভ্যাস করবেন না।






তিন...

এই ২০১৭-র এপ্রিল মাসে বসে একজন তরুণ কেন কবিতা লিখবে?

কীসের মোহ,যখন গীটার আজ জেন ওয়াই-এর যাবতীয় ক্রেজ নিয়ে চলে গ্যাছে? যখন পাঠকশূন্য সভাঘরে প্রায়  সকলেই কবি,যখন কবিরাই তাদের বন্ধু কবিদের  পড়ছেন,চাপড়ে তারা পিঠ করছেন,যখন সেলিব্রিটি কবিদের বইও হাজার দু’য়েকের বেশি ছাপার রিস্ক কোনো প্রকাশক নিতে চাইছেন না। দুই বাংলা ছেড়ে দিন,এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা কত? আর পুরস্কার!প্রায় প্রত্যেকটা Wh–র সন্দেহ আজ এগুলোর প্রতি রাখতে পারেন অনায়াসে। 


এই ফেসবুক,ব্লগজিনের যুগে কেন একজন তরুণ বিংশ শতাব্দীর মৃতদেহের ভার বইবেন ? কেন সেকেন্ডারি এক্সপিরিয়েন্স গার্গল করে যাবেন? এখনও কেন হায়াতে ডিনার সেরে এসে নিজের দারিদ্রের কুম্ভীরাশ্রু ফেলবেন?

প্রশ্নগুলো ভাবা দরকার,কিন্তু বাঙালি বহু তরুণ কবি আজ ভাবা প্র্যাকটিস করতেই ভুলে গ্যাছে। কিংবা ভোলাটাই দুর্দান্ত প্র্যাকটিস করে ফেলেছে।কিন্ত কেন,কোন রাজসত্য উলঙ্গ হবার ভয়ে? যেখানে,কবির সামাজিক সমঝোতা তো চারজন শববাহকের চেয়েও কমের হতে পারে।





চার...

এক অর্থে,সব কবিতাই বানানো। অনেক এডিট,অনেক কাটাকুটির ফসল। কিন্তু সেই কাটাকুটি যাপনের বাইরের নয়। যাপনের ধারণা চুল-দাড়ির মাপে আঁটে না,বরং সামাজিক অবস্থানের যে কোন অস্বচ্ছতাকে নিয়ত চ্যালেঞ্জ করে যায়। 

কামের প্রতি মোহ রেখে কেউ নিজেকে জিতেন্দ্রিয় ভাবলে তাকে যেমন কেবল করুণাই করা যায়,তেমনি ঋজু অবস্থানহীন যে কারোর প্রতি আজ আমার সন্দেহের চোখই থাকবে।

অনেকের তো আজও ধারণা, প্রতিষ্ঠান মানেই তেড়ে খিস্তি দিতে হবেকিন্তু, ব্যাপারটা অনেকটা "ছেলেরা/মেয়েরা তো অমনই হয়" -এর মতো হয়ে গেল না? আমি কিন্তু আজকের বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠান বিরোধীদের চিনি,যাদের কাল অভীক সরকার ফোন করলেই তারা শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো দিনে বার তিনেক (নিদেন পক্ষে) প্যারাডাইম শিফট্ করে ফেলবেন...

আরে ভাই,প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা আজকাল অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকেও ছাপিয়ে গ্যাছে...প্রচলের যে কোন ধারণার প্রতি আজ আমার সন্দেহের চোখ থাকে।খিস্তি দেবার আগে,সমর্থনের ছায়া রাখার আগে,বিরোধিতার নীল ঢালার আগে একা চলার সাহসটুকু থাক...নির্মোহ ও সততায়,আজকালকার দিনে,তাহলেই অনেকখানি পথ চলা হয়ে যাবে






পাঁচ


আমি ‘অমুকের মতো’ কবিতা লিখতে আসি নি, কিংবা নিদেনপক্ষে ‘তমুক কবিতা’। স্টেনোগ্রাফি আর গোষ্ঠীবদ্ধতা-আজকালের কবিতার জগতের এই দুই মহাপ্রতিভার বিষয়েই আমার নিজেকে ‘বঞ্চিত গোবিন্দদাস’ মনে হয়।

কারো পায়ের কাছে বসে কবিতা লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়,সে পা হর্ষ দত্ত কিংবা অনুপম মুখোপাধ্যায়-যারই হোক না কেন। কেন নয়, সেটা রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরবর্তী কবিদের সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। 

যে কোন ইজম্-এর প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্যকেই আজ আমার সংক্রমণের মতো লাগে।গলার সবটুকু স্বর যেন সে শুষে নিতে চায়। আমার ক্ষমা হোক,কিন্তু এই সংক্রমণ অনুভূতি যেন আমার কাছে এলিয়েনই থেকে যায়

একাতম হয়ে যাওয়ার অধিকার, সিগারেট খাওয়ার আগে ও সেক্স করার পরে আমার যাপনের অধিকার,আমার ভাষাপৃথিবীর অধীশ্বর আমি নিজে নির্ধারণ করার অধিকার-ওটুকু নাহয় আমারই থাক। অনুমতি হোক...

বললাম বটে। কিন্তু, নীলকণ্ঠের আদর ফ্রয়েড সাহেবরা আর কবেই বা  বুঝেছেন... 



মন ও মাতোয়ারার পুনরাধুনিক কবিতাগুচ্ছ


ক্লো রো ফিল

আতস অসাধ্য কোনো ইন্দ্রিয়দাগ আর নেই এখন

স্মৃতির ব্লেডবোধ উপেক্ষা করে
জিভের প্রাণ থরথর তরল রিসিভার,
সেও তো ছিঁড়ে ফেলা হয়ে গ্যালো বহুকাল


তবু, তোমার কুসুমতর স্নানের প্রতি
ইনফ্যাচুয়েশনের কিছু ক্লোরোফিল
                        আজও রয়ে গেল







আপনারপুর

হাড় কাটা কিছু অক্ষর তাকিয়ে আছে

তালপাতা বুলিয়ে বুলিয়ে
হাত ঠেকে যায় স্ক্রিনে

আ প না র উজ্জ্বল হাত            আরও উজ্জ্বল হউক

পড়তে বসলেই তো পুড়ে যায় প্রকৃত পাঠক







বিশ্বাসকলোনী

সুতোর তালিম কাটতে কাটতে পেরিয়ে
যাই বিশ্বাস কলোনী


দহনের মৌসম খুলে বেরিয়ে আসছে   মাং
                                                

এক প্রবল অনুকম্পার ভেতর,মনে হয়
কেবল রিফ্লেক্স আর্ক হয়ে বেঁচে আছি


                                                                (শিল্পঋণ : ডেভিড / মাইকেলেঞ্জেলো)

৩৮টি মন্তব্য:

  1. দারণ লাগলো। প্রাণিত হলাম।

    উত্তরমুছুন
  2. আগের মন্তব্যটি কবিতা সম্পর্কে করেছি।পুনরাধুনিক ভাবনায় যা বলেছেন তা পোড়ে আলোড়িত হলাম।

    উত্তরমুছুন
  3. আগের মন্তব্যটি কবিতা সম্পর্কে করেছি।পুনরাধুনিক ভাবনায় যা বলেছেন তা পোড়ে আলোড়িত হলাম।

    উত্তরমুছুন
  4. দারণ লাগলো। প্রাণিত হলাম।

    উত্তরমুছুন
  5. ভালো লাগলো !

    উত্তরমুছুন
  6. খুবভালো লাগলো, সমৃদ্ধ করল।

    উত্তরমুছুন
  7. আরও কিছু কবিতা পড়লে টের পাবো পুনরাধুনিক স্কুল অফ পোয়েট্রি হলো কিনা । তবে এই কবিতাগুলো অনুপম মুখোপাধ্যায়ের পপভাব এড়িয়ে যেতে পেরেছে ।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ।তবে,এড়িয়ে নয়,আমি বরং পেরিয়ে যেতে চাইব।

      মুছুন
  8. গদ্যটি খুব ভালো লেগেছে। ভালো বলেছেন। কবিতা গুলিও ভাল লাগলো। "সুতোর তালিম কাটতে কাটতে পেরিয়ে যাই বিশ্বাস কলোনী।" দারুণ

    উত্তরমুছুন
  9. আরও পড়ার ইচ্ছা রইল। ত‌িনট‌ি কব‌িতাই অসামান্য।

    উত্তরমুছুন
  10. 'পড়তে বসলেই পুড়ে যায় প্রকৃত পাঠক' চমৎকার ! ভালো লাগলো কবিতা ২টো। গদ্যে নিজ লেখালেখি সে সংক্রান্ত ভাবনাও । প্রমিত, স্বাগত তোমাকে ।

    উত্তরমুছুন
  11. ভাল লাগল। গদ্যটিও।

    উত্তরমুছুন
  12. বিচ্ছুরিত ভাবনার কবিতা. প্রকৃত কবির কাছে আসার সেইসব গন্ডগোল ঘটে যাচ্ছে মনে...

    উত্তরমুছুন
  13. শব্দের চাবুক চলছে । অনবদ্য

    উত্তরমুছুন
  14. আরো লেখা পাওয়ার অপেক্ষায় । ভালো লাগলো।

    উত্তরমুছুন
  15. প্রথমে টানটান গদ্য সম্পর্কে বলি। বেশ ভালো। আপনি নিজস্ব অধ্যায়টাকে তুলে ধরেছেন বেশ ঋজু ভাবে। কবিদের, বিশেষ করে তরুণ কবিদের এই নিজস্ব ভাবনা, কী ও কেন, এবং কতটা, এবং অবশ্যই কীভাবে নিজস্ব বদল ঘটানো দরকার সেই স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার, অন্তত ধারণাটা থাকা খুব প্রয়োজন। কবিতা খানিকটা মনোজগতের উতসার, বাকিটা নির্মাণ, এ কথা অনেকেই স্বীকার করেন না। স্বচ্ছ ধারণা থাকলে এই নির্মাণের দিকটা অনেকটা সুগম হয়, বলাই বাহুল্য। আপনার গদ্যটি থেকে আপনাকে খানিকটা হলেও চেনা যাচ্ছে।
    আর কবিতা নিয়ে খুব কিছু বলার নেই। কোনো কোনো কবিতা অন্তর্গত পাঠ দাবি করে, অনুভব দাবি করে। এই কবিতাগুলোও তেমনই। বেশ ভালো লেগেছে। আপনার লেখার প্রতি আগ্রহ রইল আরও প্রমিত।

    উত্তরমুছুন
  16. ধন্যবাদ যুগান্তরবাবু।অনেকটা প্রাণিত হলাম প্রতিক্রিয়াটিতে...

    উত্তরমুছুন
  17. প্রথমতঃ শিশুতীর্থ এবং প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার, দুজনেরই নিজস্ব একটা অবস্থান আছে। কেউ কাউকে ছাপিয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। আর শিশুতীর্থকে পেছনে ফেলে বৈদ্যুতিক ছুতারের দিকে এগিয়ে যাওয়া পরিণত হওয়ার উদাহরণ হতেই পারে না। আমি সারাজীবন অবন ঠাকুরের 'ভূতপতরীর দেশে' কে পৃথিবীর সেরা যাদুবাস্তব সৃষ্টি বলে যাব। যদিও এর সঙ্গে শিশুতীর্থের সরাসরি সম্পর্ক নেই, তবে আমাদের সেইসব মানুষদের কথা মনে পড়ল যারা 'শিশুপাঠ্য' বলে অনেক কিছুকেই মেঝেতে ছড়িয়ে রাখেন... আর বসারঘরের শোকেসে থাকে রবীন্দ্ররচনাবলী। আপনার উপলব্ধিগুলো পড়তে পড়তে এটা মনে পড়ল। পড়তে ভালও লাগল সবটা।


    এবার কবিতাগুলির পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাই -
    কবিতাগুলোর সব থেকে ভাল দিক হ'ল স্বল্প শব্দ ব্যয় করে ঠিক যা প্রকাশ করার সেটা প্রকাশ করা হয়েছে।
    চোখের সামনে ছবির মত গোটা শরীর জ্বলজ্বল করছে কবিতার। আমি চোখ বুঁজলে কোনও বিশেষ লাইন নয়, কবিতাটাই দেখতে পাচ্ছি। মনে যে ছাপ রইল, তাতে পরে যদি কেউ এই কবিতাগুলি এইভাবেই আমার সামনে আনে আমি ঠিক বলে দিতে পারব যেটি আপনারই লেখা কবিতা - যা, আজকাল লেখা অনেক কবিতা পড়েই পারব না। পড়তে ভাল লাগে, কিন্তু পড়ে আলাদা করে বলতে পারি না কার লেখা। আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা।

    উত্তরমুছুন
  18. মতে না মিললে যার পর নাই afraid,আর মিললে আফ্রিদি- এ আমার স্বভাবধর্ম নয়।তবে মিলে গেলে উল্লাস কিছুটা তো থেকেই যায়,যদি বোঝা যায় যে প্রতিক্রিয়াটি আসলেই প্রতিক্রিয়া, কোনো বানানো প্রক্রিয়া নয়।এরকম পাওনায় শুধু ধন্যবাদ বলা উচিত নয়,তবুও...

    উত্তরমুছুন